ইসলামকে ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে দেখানোর পরেও কেন ধর্মান্তরের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে?
জার্মানির অতি ডানপন্থী ‘অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড’ (এএফডি) পার্টির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা
আর্থার ওয়াগনার । এই দলটি চরম মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত।
আর্থার ওয়াগনারও ছিলেন চরম ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ।
তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে দলটিও ছেড়ে দিয়েছেন ।
এমনি ভাবে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষ নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ধর্ম হিসেবে ইসলামকে বেছে নিচ্ছেন। কেবল আমেরিকাতেই প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ লোক ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে থাকে এবং বর্তমান বিশ্বে ইসলাম ও মুসলিমদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করার পরও এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।
যেমন পৃথিবী ব্যাপী মুসলিমদের বিরুদ্ধে অনেকেরই অভিযোগ যে, মুসলিমরা অনেক বেসামরিক লোককে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে।
‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটিকে সরাসরি ও সহজাতভাবে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
মিডিয়া এবং নিউজ আউটলেটে মুসলিমদের সম্পর্কে এরূপ সংবাদ দেখে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, মুসলিমরা আসলেই সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে এবং জঙ্গী।
এ অবস্থায় যে ধর্ম এই ধরনের হত্যাযজ্ঞ ও বিশৃঙ্খলাকে উৎসাহিত করে, সেই ধর্মে মানুষ ধর্মান্তরিত হওয়ায় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এটা কি ব্যক্তির চরম অসামাজিক মনোভাবের ফল ?
ইসলাম ধর্মান্তরিতের মধ্যে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কিশোর থেকে শুরু করে যুবক, বৃদ্ধ সকল ধরনের মানুষকে ইসলাম আকৃষ্ট করছে।
যেমন- বেলজিয়ামের কট্টর খ্রি:ষ্টান জর্জগেট লিপোলি ৯১ বছর বয়সে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ধর্মান্তরিত এসব মানুষের প্রমাণ নিশ্চিতভাবেই সন্ত্রাসের জঙ্গী প্রচারণার সঙ্গে বেমানান।
জেনে নেয়া যাক যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন তারা কি বলেন,-
১। জোহানাহ সেগারিচ
জোহানাহ সেগারিচ বর্তমানে একজন অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। ৯/১১ হামলার পর গোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে নিজেকে এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করেছিলেন সঙ্গীতের এই অধ্যাপক।
‘এটা কোন ধরনের ধর্ম; যা মানুষকে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতে পারে?’
জোহানাহ অন্যান্য ধর্ম অধ্যয়ন করেছিলেন, কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে শেখার বিষয়টি তিনি কখনো চিন্তাও করেন নি। ইসলাম সম্পর্কে তার ধারণা ছিল- এটি পুরুষ-শাসিত এবং এখন দৃশ্যত এটি একটি সহিংস ধর্ম। তিনি তার ধারণা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে কোরআনের একটি কপি কিনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তিনি কোরআনের প্রথম অধ্যায়টি পড়েন:
পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহর নামে... সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, পরম করুণাময়, দয়াময়। ... আপনি এক, আমরা আপনার প্রার্থনা করি। আপনি এক, আমরা আপনার সাহায্য চাই, আমাদের সরল পথ দেখান, যারা আপনার অনুগ্রহ অর্জন করেছেন তাদের পথ দেখান...
কয়েক সপ্তাহ পর তিনি কোরআন সমাপ্ত করেন এবং তারপর আবার এটি পড়তে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘৯/১১ এর ১০ সপ্তাহ পর আমি কোরআনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি।’
এরপর তিনি ইসলামে ধর্মান্তর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
২। অ্যাঞ্জেলা কলিন্স
অ্যাঞ্জেলা কলিন্স টেলেস যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মেয়ে। ভ্রমণ পিয় অ্যাঞ্জেলা কলিন্স মিশর ও সিরিয়া সফর করেছেন। তিনি বিদেশে অনেক বন্ধু তৈরি করেন এবং বেশিরভাগ লোককেই তিনি উদার ও সদয় হতে দেখেছেন। ৯/১১ এর পর যখন মুসলিম বিরোধী প্রচারণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তিনি কিছু করার প্রয়োজন অনুভব করেন।
অ্যাঞ্জেলা কলিন্স বলেন, ‘আমি দেখতে পাই এসব মানুষকে সন্ত্রাসী ও নারী নির্যাতনকারী হিসেবে আমার দেশ অঙ্কিত করছে এবং সত্যের জায়গা থেকে আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে পারিনি। তাই আমি তাদের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করলাম। কিন্তু তারপর আমি বুঝতে পারি যে উপযুক্ত জ্ঞান ছাড়া আমি কোনো যুক্তি দিতে পারছি না।’
তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, ভুলভাবে অঙ্কিত করা লোকদেরকে রক্ষা করার জন্য তার কোনো ভিত্তি ছিল না। তাই তিনি কোরআন সম্পর্কে গবেষণা শুরু করেন।
গবেষণায় তার প্রাপ্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোরআনে ঈশ্বরের ধারণাটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর জিনিস এবং এই ধারণাটি আমার বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল।’
তিনি ৯/১১ এর কয়েক মাস পরেই ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
৩। কালেব কার্টার
কালেব কার্টারের মুসলমান হওয়ার জন্য কয়েক বছর সময় লেগেছিল। ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ছিল তার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। ওই সময়ে তার শিক্ষক ইসলাম সম্পর্কে বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।
কার্টার বলেন, ‘ওই সময়ে আমি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন জুনিয়র ছাত্র ছিলাম। ‘নন ওয়েস্ট্রান ওয়ার্ল্ড স্টাডিজ’ ক্লাসে শিক্ষকের কথা শুনছিলাম। এটি ছিল- ইসলাম কি শিক্ষা সে সম্পর্কে তিনি বলছিলেন। তিনি সমগ্র ইসলামকে সন্ত্রাসবাদ কার্ডের সমতুল্য বলে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন।’
কিন্তু কার্টার তার শিক্ষকের মতামতে খুবভালভাবে গ্রহণ করেননি কিংবা বুঝার মতো বয়স তার ছিল না। ইসলাম ও অন্যান্য বিশ্ব ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়ন করা তার মিশন হয়ে ওঠে এবং ২০০৬ সালে তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন।
৫। ডেভি বারকার
ডেভি বারকার ক্যালিফোর্নিয়ার একজন লেখক ও শিল্পী। তিনিও ২০০৬ সালে ধর্মান্তরিত হন। বার্কার শিশু বয়সে বাবা-মার সঙ্গে কয়েক বছর সৌদি আরব ও মালদ্বীপে কাটিয়েছেন এবং মুসলিম দেশের মুসলমানদের সম্পর্কে জানতেন।
তাই তিনি বিশ্বাস করতেন না যে সন্ত্রাসী হামলার জন্য ধর্মই দায়ী। তিনি বলেন, ‘আমি দেখেছি ওই সময়ে কিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অপ্রচার চালানো হয়েছে এবং তা আজো চলছে।’
এখন প্রশ্ন হলো সন্ত্রাসী ক্রিয়াকলাপের মধ্যেও কেন ইসলামে ধর্মান্তরের ঘটনা বাড়ছে?
৯/১১ এর ঘটনা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইসলাম সম্পর্কে জানতে মানুষকে মানুষকে প্রভাবিত করেনি। এর পিছনে কারণগুলো হচ্ছে:
প্রথমত,
যারা ধর্মান্তরিত হয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আরো ভালভাবে বুঝে নিতে চেয়েছেন যে, কিভাবে কোন ধর্ম এমন মন্দ হতে পারে। কোন ধর্মকে মন্দ বলাকে তাদের অনেকের কাছে একটি অপ্রীতিকর দাবি বলে মনে হয়েছে। এই বিষয়টি অনেকেই সহজেই মেনে নেয়নি বলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছেন।
দ্বিতীয়ত,
অনেকেই ইসলামকে একটি ধাপ্পাবাজি ধর্ম হিসেবে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। ইসলামকে ছোট করে দেখাতে গিয়েই ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয় এবং আসল সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে মোসলমান হয়ে যান।
তৃতীয়ত,
অনেকেরই মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাদের সঙ্গে চলতে গিয়ে তারা বুঝতে পারেন যে, তারা রক্ত পিপাসু ছিল না। ইসলাম সম্পর্কে মিডিয়ার মানসিক বিকারগ্রস্ততা তাদের চোখের সামনে উপস্থিত হয়। নির্দোষ মানুষগুলোকে নিয়ে মিডিয়ার ভুল চিত্রনাট্য সম্পর্কে তারা বুঝতে পারেন। তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের অবস্থানের জন্য বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে তাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু তারা ইসলাম সম্পর্কে না জেনে ভুল ও বিরুধী ভাবে ইসলামকে প্রচার করেছে ।
যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১ এর বর্বরতা এবং প্যারিসে গণহত্যার জন্য মুসলমানদের কেবল অভিযুক্তই করা হয়নি, বলা হয়ে থাকে- এসব সহিংসতাকে ইসলাম নিজেই অনুমোদন করেছে।
আসলেই কী তাই?