শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৫

হযরত শাহজালাল(র:)


হযরত শাহজালাল (র:) ছিলেন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ওলিদের মধ্যে অন্যতম।তিনি বাংলা ও আসাম অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে আগত আউলিয়াদের পথিকৃত।এ কারণে হযরত শাহজালাল (র)কে বাংলাদেশে আওলিয়াকূল শিরোমনি হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়।তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল এক মুজাহিদ বাহিনী।যাঁরা জীবনভর ত্যাগ ও মেহনতের মাধ্যমে বাংলা ও আসামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের শাশ্বত বাণী ও তৌহিদের সুমহান পয়গাম পৌঁছে দেন। ফলে আজ বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে।
 
হযরত শাহজালাল (র:) হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দশকে ৫৯৬ হিজরী ১১৯৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ মাতার নাম সৈয়দা ফাতিমা
শায়খ বা শেখ সাধনাগত উপাধি।।সাধনায় যিনি সিদ্ধি লাভ করেন করেন তিনি শায়খ বা শেখ উপাধি লাভ করেন।শায়ক অর্থ বুজর্গও বুঝায়।শাহ শব্দও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।ফার্সী শাহ ও আরবী শায়ক বা শেখ শব্দ দুটি একই অর্থ বহন করে।
সিলেট শহরের প্রাণ কেন্দ্রে একটি মনোরম নাতি উঁচু টিলার উপর হযরত শাহজালাল (র:) এঁর মাজার শরীফ অবস্থিত।অগণিত ফকির দরবেশ আশেকান হৃদয়ে তাপ বিদগ্ধ মানব কূলের কাছে হযরত শাহজালাল (র:) দরগাহ শরীফ পূন্যতীর্থ হিসাবে সর্বজনমান্য।এখানে এসে আশেকান লাভ করেন হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি।পীর,ফকির,সাধক দরবেশগণ লাভ করেন আধ্যাতিক জ্যেতির সন্ধান।জীবন সংগ্রামে পর্যূদস্তু আর ঘাত প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত আদম লাভ করেন জীবনের ক্লেশ মুক্তির ইশারা ।মারেফাতের আবেহায়াত সন্ধানী পীর ফকির সুফি দরবেশ সংসার ত্যাগী মানব সন্তান আলেম ওলামা লাভ করেন বাতেনী ইলমের আবেহায়াত।
সিলেটের পবিত্র ধূলাবালির পরতে পরতে রয়েছে আল্লাহ পাকের অফুরন্ত কুদরতের লীলাখেলা।এখানকার পথ প্রান্তর,হাওর-জঙ্গল আর দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল সবুজ জমিনের চোখ জুড়ানো মন ভোলানো প্রাকৃতিক পরিবেশে রয়েছে পীর-ফকির,সূফি-দরবেশ,গাউস-কুতুব,বাউল-বৈরাগীর নীরব সাধনার ক্ষেত্র।
হযরত শাহজালাল (র:) এঁর রুহানী শক্তিতে সিলেটের জমিনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে।মুজাহিদ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র:)।সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র:) এঁর নেতৃত্বে সিলেট বিজয়ের পর গৌড়গবিন্দের সমসাময়িক রাজা আচাক নারায়নের রাজ্য রাজপুর বা তুঙ্গাচল বা তরপ (হবিগঞ্জ জেলা)বিজিত হয়।সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র:) এঁর নেতৃত্বে অভিযানে বারোজন আউলিয়া অংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে তরপকে(হবিগঞ্জ জেলা) বার আউলিয়ার দেশ বলে অভিহিত করা হয়।
হযরত শাহজালাল (র:) আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করার পর সৈয়দ আহমদ (র:) এঁর নিকট হতে খিলাফত লাভ করেন।অত:পর তিনি পীরের অনুমতি নিয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সাতশত অনুচর সহ মাতৃভূমি ত্যাগ করেন।এ সময়ে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম শাসন ও সংস্কৃতি ধ্বংশ করে চলেছিল।তিনি মনে করলেন মোসলমানদের রক্ষায় আল্লাহর পথে জিহাদ করা তাঁর পবিত্র দায়িত্ব এবং তিনি এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। ইবনে বতুতার মতে,১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে যথন হালাকু খান শেষ আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহকে হত্যা করেন ও তার রাজধানী লুন্ঠন করেন তখন হযরত শাহজালাল(র:)বাগদাদে উপস্থিত ছিলেন।বিদায় কালে হযরত শাহজালাল (র:) এঁর মুর্শিদ আরবের কোন এক স্থানের এক মুটো মাটি দিয়ে বলেছিলেন,-
‘যেখানের মাটির স্বাদ,বর্ণ ও গন্ধ এ মাটির সাথে মিলে যাবে,সেখানে আস্তানা স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।’
মাটি পরীক্ষার ভার যে দরবেশের উপর ন্যাস্থ ছিল তাঁর উপাধি দেয়া হয় ‘চাশনীপীর’।
তিনি দিল্লীতে এসে হযরত নিযাম উদ্দীন আউলিয়া (র:)এঁর সাথে মোলাকাত করেন।হযরত নিযাম উদ্দীন আউলিয়া (র:) তাঁকে একজোড়া সুরমা রংয়ের কবুতর উপহার দেন,যা জালালী কবুতর নামে পরিচিত।
অত:পর তিনি সাথীদের নিয়ে বাংলোর দিকে অগ্রসর হন।সেনাপতি সিকান্দর গাজীকে সিলেট বিজয়ে সাহায্য করেন।
সিলেটের অত্যাচারী রাজা  গৌড়গোবিন্দ কর্তৃক জনৈক শায়খ বুরহান উদ্দীন (র:) প্রতি অত্যাচারের প্রতিবিধানার্থে বাংলার সুলতান শামসউদ্দীন ফিরোজ শাহ তাঁর ভাগ্নে সিকান্দর গাজীকে সিলেটে প্রেরণ করেন।চলার পথে সিকান্দর গাজী সোনারগাঁও দখল করেন।কিন্তু গৌড়গোবিন্দের কাছে সফল হতে পারেননি। তিনি গৌড়গোবিন্দের বিরোদ্ধে যুদ্ধে তিনবার বিফল হন।অত:পর দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি(১২০৬-১৩৮৬ খিষ্টাব্দ)তাঁর সেনাপতি সৈয়দ নাসির উদ্দিনকে সিকান্দর গাজীর সাহায্যার্থে প্রেরণ করেন।হযরত শাহজালাল (র:) ও তাঁর ৩৬০ জন আউলিয়া সেখানে উপস্থিত হন।সাতগাঁওয়ের নিকট ত্রিবিনীতে সৈন্য দলের মধ্যে হযরত শাহজালাল (র:) ও তাঁর মুজাহিদ বাহিনীর উপস্থিতির ফলে সেনাদল নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠে ।সম্মিলিত সেনাবাহিনী এবার সিলেট বিজয়ে কৃতকার্য হন।
সিলেটের মাটির সাথে মুর্শিদ প্রদত্ত মাটি হুবাহু মিলে যায় ।তিনি সিলেটে আস্তানা স্থাপন করেন এবং ধর্ম প্রচার ও মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।স্থানীয় লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচার নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি বিজিত এলাকার ভার কয়েকজন শিষ্যের উপর ন্যাস্থ করে তাঁর সাথী ৩৬০ আউলিয়ার মাধ্যমে সারা বাংলা ও ভারতের করিমপুরে ইসলামের তৌহিদের শ্বাশত বানী প্রচার করেন।
ইবনে বতুতার  বর্ণনায় তাঁর সংযম,নিষ্ঠা ও সেবাধর্মী জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়।এই মুর দেশীয় পরিব্রাজক ইবনে বতুতা যখন তাঁর সাথে স্বাক্ষাত করেন,তখন  তিনি খুবই বৃদ্ধ বয়সে উপনীত ।হযরত শাহজালাল (র:)  ক্ষীণকায় ও লম্বা আকৃতির ছিলেন।তাঁর অল্প দাড়ি ছিল।তিনি প্রায় চল্লিশ বছর একাধারে রোজা রেখেছেন।দশদিন অন্তর রোজা ভাংতেন।তাঁর একটি গাভী ছিল।সেই গাভীর দুধই ছিল তাঁর একমাত্র প্রধাণ খাদ্য ।তিনি সারারাত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন।ইবনে বতুতা আরোও বলেন যে,এই মহান  দরবেশ শায়খের মেহনতের ফলেই ঐ অঞ্চলের অধিবাসীরা ইসলামে দীক্ষিত হয় এবং তাঁর জন্য তিনি তাদের মধ্যে বসতি স্থাপন করেন।তিনি একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন ।এই খানকাহ ছিল সুফি-দরবেশ মুসাফির ও দু:স্থ মানুষের আশ্রয় স্থল।হিন্দু-মোসলমান সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো।তারা তাঁর জন্য নানা প্রকার থাদ্য সামদ্রী ও নিয়াজ নজর আনতো।এগুলো দিয়েই আস্তানার লোকদের খাওয়ানো হতো।

তাঁর মহত আদর্শ জনগণের মনে এমন গভীর ভাবে রেখাপাত করেছে যে,তারা তাঁকে একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব কামেল বুজর্গ ব্যক্তি মনে করে ভক্তি ভরে ছুটে আসে তাঁর মাজার যিয়ারতে।
১৫০ বছর বয়সে ১৩৩৭ সালে এই দরবেশ ইন্তেকাল করেন ।কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।তবে ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত জনাব দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী রচিত হযরত শাহজালাল (র:) গ্রন্থে তাঁর জীবন কাল ১৫০ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
 সকল প্রকার শিরক ও বিদআতকে বিনাশ করে দিয়ে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল হযরত শাহজালাল (র:) ও তাঁর ৩৬০ জন আউলিয়ার জিন্দেগীর একমাত্র উদ্দেশ্য ।কিন্তু দু:খের বিষয়,শিরক ও বিদআদ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা থাকার কারণে আমরা এই মহান ওলি আউলিয়াদের কবরকেই প্রায় ক্ষেত্রে শিরক ও বিদআতের আখড়া হিসাবে পরিণত করে ফেলেছি,যদিও আমাদের হৃদয়ে ভক্তি শ্রদ্ধার কোন ক্রুটি নেই।শিরক একটি জঘণ্যতম গুনাহের কাজ।শিরক সমস্ত আমলকে বিনাশ করে দেয়।
এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক কোরআনে বলেছেন,-
‘যদি তারা শিরক করে থাকে তবে তারা যা কিছু আমল করেছে সব কিছুই বরবাদ হয়ে যাবে’।
শিরক বিদআতের গোনাহ হতে  মহান আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
আমিন।।