আল্লাহ
আল্লাহ্ (আরবি: ﺍﷲ আল্লাহ্) হল ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী একটি আরবি শব্দ যার মানে হল "বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা এবং প্রতিপালকের নাম"। "আল্লাহ" শব্দটি প্রধানতঃ মুসলিমরাই ব্যবহার করে থাকেন। আসলে “আল্লাহ্" হল এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকতার সাধারন ভাবে বহুব্যবহৃত নাম ৷ এই নাম ছাড়া ওনার আরও অসংখ্য নাম আছে ৷ কোরআন শরীফে আল্লাহ্র নিরানব্বইটি নাম উল্লেখ আছে , তার মধ্যে কিছু হল:: সৃষ্টিকতা, ক্ষমাকারী, দয়ালু, অতিদয়ালু, বিচারদিনের মালিক, খাদ্যদাতা, বিশ্বজগতের মালিক প্রভৃতি ৷৷তবে আরবি খ্রিস্টানরাও প্রাচীন আরবকাল থেকে "আল্লাহ" শব্দটি ব্যবহার করে আসছেন। বাহাই, মাল্টাবাসী, মিজরাহী ইহুদি এবং শিখ সম্প্রদায়ও "আল্লাহ" শব্দ ব্যবহার করে থাকেন।
- ১. আল্লাহর কোন অংশীদার নেই, কোন সমকক্ষ নেই এবং কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই
- ২. আল্লাহর কোন পিতা, মা, পুত্র বা স্ত্রী নেই
- ৩. কাউকে বা কিছু একটি মধ্যবর্তী হিসেবে কাজ করা ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর উপাসনা করা যায়
- ৪. আল্লাহর কেউ এর উপাসনার প্রয়োজন হয় না
- ৫. আল্লাহ কারো জবাবদিহি হয় না
- ৬. আল্লাহ কোন ব্যক্তি বা জিনিসের উপর নির্ভরশীল নয়. বরং সকল ব্যক্তি এবং সবকিছু আল্লাহর উপর নির্ভরশীল
- ৭. আল্লাহ কারো সহায়তা ছাড়াই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারেন
- ৮. কিছুই আল্লাহর উপরে বা আল্লাহর সঙ্গে তুলনীয় নয়
- ৯. বিদ্যমান কিছুই নেই যা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর পরাধীন নয়
- ১০. কেউ প্রতিরোধ করতে পারেন না, যা আল্লাহ প্রদান করে, আর কেউ প্রদান করতে পারেনা যা আল্লাহ প্রতিরোধ করে
- ১১. শুধুমাত্র আল্লাহই কারো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে, এই ক্ষমতা অন্য কেউ রাখেনা
যারা এধরনের প্রশ্ন করে তাদেরকে আপনি যদি একটা যুক্তিযুক্ত উত্তর দেয়া হলেও, সাথে সাথে তারা প্রশ্ন করবেঃ
“আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্টের জীবন দিল, যেখানে অন্যরা কত শান্তিতে আছে? আমি কি বলেছিলাম আমাকে এতো কষ্ট দিতে?”
আপনি যদি ব্যাখ্যা করেন কিভাবে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমন ভাবে বানানো হয়েছে যে, কেউ ধনী হলে তিনি আরো ধনী হতে থাকবেন এবং তিনি অন্য অনেক মানুষকে তার মুখাপেক্ষী থাকার জন্য গরীব করে রাখবেন অথবা গরীব বানিয়ে ছাড়বেন, তখন তারা এই ধরণের প্রশ্ন করা শুরু করবেন:
“আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানালো কেন, আমিতো মেয়ে হতে চাইনি? আল্লাহ আমাকে কালো কিন্তু অন্যদেরকে ফর্সা বানাল কেন, এটা তো ঠিক হল না? আমি খাট কেন, লম্বা না কেন? আমার কপালে এরকম বদ স্বভাবের শয়তান স্বামী পড়ল কেন? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি, রোযা রাখি, কোনদিন ঘুষ খাইনি, কারো সাথে খাড়াপ আচরণ করিনি,কিন্তু তারপরেও আমার ক্যান্সার হল কেন?”
এই ধরনের “আমি, আমার, আমাকে” প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার পর তারা চলে যাবে আরও জটিল সব ঘটনায়ঃ
“সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন? মুসলমানরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি? সব টেররিস্টগুলো মুসলমান কেন? কেন ধর্মের নামে এতো খুনাখুনি, যুদ্ধ? আল্লাহ কেন শয়তানকে বানালো? শয়তান না থাকলে তো আমরা সবাই বেহেস্তে যেতে পারতাম। আল্লাহর মানুষ বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে এতো কষ্ট দেবার দরকার কি ছিল? সরাসরি মানুষকে বেহেস্তে পাঠালেই তো হয়ে যেত। আল্লাহ কি জানে না কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি? আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি? আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন? এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে অনন্তকাল এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো যক্তি সংগত হলো না ,ন্যায় সংগত হলো না,এটাতো অন্যায়।”
এধরণের প্রশ্ন শুধু যে অমুসলিম, নাস্তিকরা করে তাই না, আজকাল মুসলমানদের মধ্যেও ব্যাপক হারে এধরণের প্রশ্ন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে আমরা যখনি কোন জটিল শারীরিক, মানষিক, পারিবারিক, সামাজিক সমস্যায় পড়ি, তখনি আল্লাহর সম্পর্কে এই ধরণের অভিযোগ করা শুরু করে দেই।
এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি প্রশ্নকারীদেরকে তিন ভাগে ভাগ করবঃ
*অসহায় ক্যাটাগরিঃ কেন
আমাকে বানাল,
কেন আমার
এতো কষ্ট,
কেন আমার
এত অসুখ,
…
*স্বার্থপর ক্যাটাগরিঃ আমি
মেয়ে কেন,
আমি কালো
কেন, আমার
এতো অভাব
কেন, …
*দার্শনিক ক্যাটাগরিঃ কেন
শয়তান, কেন
দোযখ, কেন
পৃথিবীর দরকার,
সোজা বেহেস্ত
দিলেই তো
হত, …
এখন এই তিন ধরণের ক্যাটাগরির মানুষের
জন্য তিন
ধরণের ব্যাখ্যা
দিব, ..কিন্তু যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদেরকে প্রথমে ‘আল্লাহ’ বলতে আমরা কি ধরনের সত্ত্বার কথা বলছি, তার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি না করবো ‘আল্লাহ’ কে? ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলে বুঝা যাবে না,দিয়ে লাভ হবে না। সবসময় মনের মাঝে একটা ‘কিন্তু…’ থেকেই যাবে।
আজ থেকে মাত্র বিশ বছর আগেও আপনি যদি কাউকে বলতেন যে শীঘ্রই আপনি ফার্মগেটে বাসে ঝুলতে ঝুলতে বাংলাদেশে থেকে আমেরিকায় কারও সাথে সরাসরি কথা বলতে পারবেন, সে আপনাকে পাগল ভাবতো। কিন্তু এখন আমাদের সবার হাতে দেখুন মোবাইল ফোন রয়েছে। আজ থেকে পনের বছর আগেও যদি কাউকে বলতেন শীঘ্রই আপনি বান্দরবনের এক পাহাড়ে বসে আমেরিকায়, যুক্তরাজ্যে, চায়নায় কয়েকজন মানুষের সাথে সরাসরি শুধু কথাই বলতে পারবেন না, একই সাথে তাদেরকে দেখতেও পারবেন, ফাইল আদান প্রদান করতে পারবেন, তাহলে সে আপনার দিকে আতংক নিয়ে তাকাতো। কিন্তু দেখুন এখন Skype মানুষের ঘরে ঘরে। গত একশ বছরে মানুষ জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে এতোটা এগিয়ে গেছে যেটা গত হাজার বছরেও হয়নি। মানুষ যদি মাত্র একশ বছরে এমন সব কল্পনাতীত অর্জন করতে পারে, তাহলে মানুষ আজ থেকে দশ হাজার বছর পরে কোথায় যাবে, সেটা এই বিংশ শতাব্দীতে বসে আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। মানুষের উন্নতি যদি একই ধারায় চলতে থাকে, তাহলে আজ থেকে দশ হাজার বছর পরের মানুষ আমাদের থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতো এগিয়ে যাবে, চিন্তার ক্ষমতায় এতো উন্নত হবে, মানসিক ধারণ ক্ষমতা এতো বেশি হবে যে, বানর এবং মানুষের মধ্যে যে রকম ব্যাপক ব্যবধান, তাদের সাথে আমাদের ব্যবধান হবে সে রকম। সেই উন্নত মানবজাতির কেউ একজন যদি আজকে আমাদের কাছে কোনো ভাবে চলে আসে, তাহলে সে চারিদিকে তাকিয়ে শুধুই আদিম যুগের মানুষ গোছের কিছু মানুষ দেখবে। আমাদের কাছ থেকে তার কিছুই শেখার বা জানার কিছুই থাকবে থাকবে না, এমনকি তার কথা বোঝার মতো যথেষ্ট মানষিক বুদ্ধি ও ক্ষমতাও আমাদের থাকবে না।
তাহলে চিন্তা করে দেখুন যে মহান সত্ত্বা ১৬০০ কোটি বছরের (মহাবিশ্বের বয়স) থেকে অনেক বেশি সময় ধরে আছেন, যিনি মানুষের মতো অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি করতে পারেন, যিনি এই বিশাল পৃথিবীকে সৃষ্টি করতে পারেন, যিনি পৃথিবীর মতো এরকম একটি দুটি নয়, বরং ১০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ এরও বেশি গ্রহ, নক্ষত্র সৃষ্টি করে তাদের সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সে মহান আমাদের চেয়ে কতো উপরে হতে পারে ?সে ধারণা কি আমরা করতে পারবো ?কখনো নয় । তাঁর জ্ঞান, তাঁর “মানসিক” ক্ষমতা, তাঁর পরিকল্পনা, তাঁর সৃজনশীলতা কোন্ পর্যায়ের হতে পারে, সেটা আমাদের পক্ষে কোনভাবেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়, যেখানে কিনা আমরা নিজেরাই দশ হাজার বছর পরে পৃথিবী কি পর্যায়ে পৌছাবো সেটাই কল্পনা করতে পারি না।যারা আল্লাহর সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে নানা ধরণের প্রশ্ন করে, তারা আসলে আল্লাহ কে এবং সে কে – সেটাই তারা বোঝে না। তারা মনে করে তারা তাদের বিবেক বুদ্ধি ব্যবহার করে আল্লাহর জ্ঞান, সিদ্ধান্ত, কাজের মধ্যে অনেক ফাঁক ফোঁকর বের করে ফেলেছে, যেটা আল্লাহ বের করতে পারেন নি। তাদের এই মনোভাব কতো হাস্য কর !বাইবেলে এর একটা চমৎকার উত্তর দেওয়া আছেঃ
“Destruction is certain for those who argue with their Creator. Does a clay pot ever argue with its maker? Does the clay dispute with the one who shapes it, saying, ‘Stop, you are doing it wrong!’ Does the pot exclaim, ‘How clumsy can you be!’ How terrible it would be if a newborn baby said to its father and mother, ‘Why was I born? Why did you make me this way?
যারা তাদের প্রভুর সাথে তর্ক করে তাদের ধ্বংস নিশ্চিত। একটা মাটির পাত্র কি কখনও কামারের সাথে তর্ক করে? মাটি কি তাকে বলে, “থামো, তুমি ভুল করে বানাচ্ছ!” মাটির পাত্রটা কি অভিযোগ করে, “তুমি এতো খামখেয়ালি কেন?” কি বাজে ব্যপার হবে যদি একটা শিশু জন্ম নিয়েই তার বাবা-মাকে প্রশ্ন করে, “আমি জন্ম হলাম কেন? আমাকে এরকম করে জন্ম দিলে কেন?” (Isaiah:45:9-10)
কু’রআনের পুরো বাণীকে যদি এক লাইনে বলা যায়, তাহলে কু’রআনের বাণী হচ্ছেঃ
আল্লাহ হচ্ছে তোমার প্রভু, তুমি হচ্ছ আল্লাহর একজন দাস বা গোলাম।
একজন দাসকে তার প্রভু যা ইচ্ছা দিতে পারে, যা ইচ্ছা কেড়ে নিতে পারে। এখানে দাসের অভিযোগ করার কিছুই থাকরেত পারে না। প্রভু কোন বন্ধু না যে দাসকে তার কোন জবাব দিতে হবে। আমার যদি একটা গরু থাকে এবং গরুটা দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিলে আমি যদি তাকে বিক্রি করে দিতে চাই, তখন যদি গরুটা আমার সাথে তর্ক শুরু করে, “আমি না এত দুধ দিলাম? আমাকে বিক্রি করবা কেন?” – তাহলে ব্যপারটা কেমন দাঁড়ায়?
এই পর্যায়ে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষের প্রতিক্রিয়া হয়ঃ
“না, এটা তো ঠিক হল না! আল্লাহ আমাদের প্রভু এবং আমরা দাস হলেই কি আল্লাহ আমাদেরকে নিয়ে যা খুশি তাই করবে? এটা কেমন এক প্রভুর সংজ্ঞা হল?”
আল্লাহ দুনিয়ার কোন ক্ষমতাধর মানুষের মতো প্রভু নন। প্রভু-দাস এই শব্দগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন ভালো ধারণা নেই কারণ প্রভু হিসেবে মানুষ সাধারনত অন্য মানুষের প্রতি সবসময়ই নিষ্ঠুর, স্বেচ্ছাচারী, অত্যাচারী হয় নিজের ভোগবাদী সুবিধা বহাল রাকার জন্য । আর দাস বলতে আমরা সবসময় বুঝি অত্যাচারিত, অধিকার বঞ্চিত, মজলুম ,যার সামান্য প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই গরিব মানুষ।
কিন্তু আল্লাহ তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন সুরা ফাতিহাতেঃ
পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। সমস্ত প্রশংসা-মহিমা-ধন্যবাদ আল্লাহর, যিনি সৃষ্টি জগতের প্রভু। পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়। (১:১-৩)
এখানে আল্লাহ বার বার বলেছেন, তিনি হচ্ছেন পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময় প্রভু। তিনি মানুষের মত অল্প করুণাময়, মাঝে মাঝে করুণাময় নন বা সুবিধা প্রাপ্তির বিনিময়ে করুণাময় নহেন।। আল্লাহ কিন্তু শুধুই বলতে পারতেন “তিনি পরম করুণাময়”, ব্যাস। কিন্তু একজন পরম করুণাময় কিন্তু সবসময় করুণা নাও দেখাতে পারেন। তিনি সকালে করুণা দেখালেন, রাতে আর দেখালেন না। কিন্তু না, তিনি নিরন্তর বা বিরামহীন করুণাময়, তিনি প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে করুণা করছেন। আপনি যখন সকালে ফজরের এলার্ম বন্ধ করে নামায পড়বেন কিনা তা কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করে আবার ঘুম দেন, তখন আপনার একটা হাত খুলে পড়ে যায় না। আপনি যখন একজন অন্ধ ফকিরের পাশ দিয়ে না দেখার ভান করে হেটে চলে যান, তখন কিন্তু আপনার চোখ দুটা নষ্ট হয়ে যায় না। কারণ আল্লাহ নিরন্তর করুণাময়। আপনি তাঁর এক মামুলি দাস হয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় তাঁর আদেশের গেস্ডির মধ্যে থেকে তাঁকে অমান্য করছেন, তাঁকে আপনার পরিবারের সদস্যদের চাহিদা থেকে কম গুরুত্ব দিচ্ছেন, এভাবে ক্রমাগত তার আদেশ ভেঙ্গে আপনার দিমাগ মতো আপনি চলার পরেও তিনি আপনাকে প্রতিদিন ছেড়ে দেন। কারণ তিনি নিরন্তর করুণাময়, চরম ধৈর্যশীল।
এছাড়াও তিনি বলেছেন – সমস্ত প্রশংসা, মহিমা, ধন্যবাদ তাঁর। তিনি যাই করেন, সেটাই প্রশংসনীয়। সেটা আমরা আমাদের নগণ্য বুদ্ধি নিয়ে বুঝি, আর নাই বুঝি। একটা সামান্য পিঁপড়া যেভাবে হাজার হাজার পিঁপড়ার সাথে ক্রমাগত যোগাযোগ করে, যার সমকক্ষ কিছু মানুষ এখনও তৈরি করতে পারেনি; যেভাবে মৌমাছিরা ভূমিকম্প প্রতিরোধক বাসা তৈরি করে, যা মানুষ এখনও বানাতে পারেনি, যেভাবে এক মামুলি ঘাস নাইট্রোজেন জমা করে হাজার ধরণের ছোট বড় প্রাণীকে প্রোটিন সরবরাহ করে, যার ধারে কাছে কোন কিছু মানুষ বানাতে পারেনি – এসব কিছুর মধ্যে আল্লাহর বিরাট প্রশংসা এবং মহিমা রয়েছে। আমরা মানুষরা যদি আল্লাহর এই মহিমা উপলব্ধি করে তাঁর প্রশংসা না করি, আল্লাহর তাতে কিছুই যায় আসে না। আমরা শুধু শুধুই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবো।
“তাহলে আমার এতো অভাব কেন? আমার এতো অসুখ কেন?”
স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নগুলো আসে। “যদি আল্লাহ সত্যিই পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়, সকল প্রশংসা পাবার যোগ্য হন, তাহলে আমার এই করুণ অবস্থা কেন?”
আপনার সমস্যা হচ্ছে আপনি মনে করছেন, যদি আল্লাহ পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়, সব প্রশংসার অধিকারী হন, তাহলে আপনার জীবনটা হবে বেহেস্তের জীবনের মতো। আপনার যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক – আল্লাহ আপনাকে কোন টাকা পয়সার অভাব দিবেন না। আপনার দাদা-নানা তাদের জীবনে ফাঁকিবাজি করে আপনার বাবার জন্য জীবনটা সচ্ছল করে দিয়ে যাক বা না যাক, আল্লাহ আপনার জীবনটা ঠিকই আরামে পার করে যাবার সব ব্যবস্থা করে দিবেন। আপনি প্রতিদিন লক্ষ মানুষের মল মিশ্রিত ঢাকা ওয়াসার দুষিত পানি পান করেন আর নাই করেন, আল্লাহ আপনার পাকস্থলিকে এতো শক্তিশালী করে দিবে যে সেই পানি খেয়েও আপনার কোন অসুখ হবে না। আপনি প্রতিদিন ফরমালিন দেওয়া ফল, মাছ খান বা না খান, আলাহ প্রতি মাসে আপনার শরীরের সব কোষকে নতুন করে পাল্টিয়ে দিয়ে কখনও আপনার শরীরে ক্যানসার হতে দিবেন না।
আপনি কু’রআনের উপদেশ মেনে আপনার জীবন পার করবেন না, কিন্তু তারপরেও আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে কোন সমস্যা থাকবে না। আল্লাহ মহাবিশ্বের সব নিয়ম কানুন ভেঙ্গে, বিশ্বের সমস্ত মানুষের সব খারাপ কাজের প্রভাব থেকে আপনাকে মুক্ত রেখে; সমস্ত জীবাণু, রাসায়নিক বিষক্রিয়ার প্রভাব থেকে আপনার দেহকে প্রতিরোধ করে; অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, সমস্ত ঘটনাকে আপনার সুবিধা মত পরিবর্তন করে, আপনার কাছে যখন যেটা সমস্যা মনে হবে, সেটাই তিনি দূর করে দিবেন। এই হচ্ছে আপনার মতে “পরম করুণাময়, নিরন্তর করুণাময়” এর সংজ্ঞা।
কিন্তু সেটা আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা নয়। এখন আপনি বলবেনঃ
“তাহলে আমার দোষ কি? আমাকে দুনিয়াতেও কষ্ট করতে হবে আবার দোযখের শাস্তিও পেতে হবে? এটা কেমন ন্যায় বিচার হল?”
তোমার প্রভু কারো সাথে একটুও অবিচার করবেন না। ১৮:৪৯
কিয়ামতের দিন যখন পাপীদেরকে জাহান্নামে নেওয়া হবে, তখন কেউ দাবি করবে না যে তাকে অন্যায়ভাবে জাহান্নামে নেওয়া হচ্ছে। সবাই যখন তাদের কাজের ফলাফল দেখতে পাবে, তখন সবাই নিজেরাই বুঝতে পারবে যে সে শাস্তি পাবার যোগ্য।
একই ভাবে দুনিয়াতে প্রতিটি কষ্টের জন্য আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে ছাড় দিবেনই, যদি মানুষ কষ্টে পরেও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলে, আল্লাহকে অভিযুক্ত না করে বরং তার বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকে।
‘আমি’ তোমাদেরকে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, এবং সম্পত্তি, জীবন ও ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। তবে (মুহম্মদ) ধৈর্যধারণকারীদের সুসংবাদ দিন। যাদেরকে দুর্ঘটনা/বিপর্যয়/কষ্ট আঘাত করলে বলে, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং তাঁর কাছেই আমরা ফেরত যাব।” তাদের উপরেই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ এবং দয়া রয়েছে এবং তারাই সঠিক পথে আছে। (২:১৫৫-১৫৭)
যারাই জীবনে পরীক্ষায় পড়ে আল্লাহকে দোষ না দিয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিবে এবং ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং চলুন আমরা বেশি করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলো ধৈর্য নিয়ে পাস করার সামর্থ্য দেন।
এছাড়াও আরেকটি অসাধারণ আয়াত হলঃ
তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহর কি লাভ? ৪:১২৭
আল্লাহ কেন আমাদেরকে খামোখা শাস্তি দিবেন? তাঁর তো আমাদেরকে শাস্তি দিয়ে কোন লাভ নেই। তিনি আমাদেরকে শাস্তি তখনই দিবেন যখন আমরা শাস্তি পাবার মত কাজ করবো। আপনি আমি যখন Nando’s চিকেন খাই, আর আমাদের পাশের গলিতে একটা লোক না খেয়ে ছেড়া চাদর গায়ে দিয়ে রাস্তায় ঘুমায়, কোন ক্ষধার্ত ডাষ্ট বিন হতে খাবারের উচ্ছিষ্ট খুজে নিয়ে খায় ,তখন আমাদেরকে যখন জাহান্নামে নেওয়া হবে, আমরা কিন্তু সেটাকে “এটা ঠিক হল না!” বলে চিল্লাচিল্লি করবো না। আমরা যখন আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে নিয়ে দামী ফোনে গেম খেলি,বিশাল এল ই ডি /এল সি ডি টিভি দেখি,অভিজাত রেস্টুরেন্টে দামী খাবার খাই, ভালো ব্যয় বহুল স্কুলে পাঠাই, কিন্তু তাদেরকে দশ মিনিটও কু’রআনের মর্ম পড়ে শোনাই না, সারা জীবনে তাদেরকে আল্লাহর পাঠানো একমাত্র বইটার মর্ম বুঝাই না; তারপর তারা বড় হয়ে যে নৈতিকতার বিশ্বাসী হয় সে বিশ্বাসে তার নিজের বৈষয়িক উপকার হতে পারে,তার নিজস্ব স্বল্প গন্ডির উপকার হতে পারে,দেশের জনগণের উপকারে লাগে না,কারণ তার বিশ্বাস আল্লাহর সাথে নেই, সুদের লোণ নেয়, বন্ধু বান্ধব নিয়ে পার্টি করে, অশ্লীল সিনেমা দেখে, মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে, ফুটানি করে, গরিবের সাথে অন্যায় করে – তখন সেই সমস্ত গুনাহর কারণে আমরা পরোক্ষ ভাবে ভাগীদার হচ্ছি সমাজে আল্লাহর রহমত প্রবেশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টির পরিবেশ হয় এবং আখিরাতে আমাদের যখন মাথা নিচু করে জাহান্নামে যেতে হবে, তখন আমরা প্রশ্ন করবো না – “আমার কি দোষ ছিল!?”
আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে একটা চমৎকার কথা বলেছেনঃ
যখন আমি মানুষকে অনুগ্রহ করি তখন সে গর্বে নিজের মত থাকে, কিন্তু যেই না খারাপ কিছু হয়, সাথে সাথে সে লম্বা দোয়া করা শুরু করে। ৪১:৫১
যারা এই সব প্রশ্ন করে, দেখবেন তাদের দিনকাল যখন বেশ ভালো যায় – কোন অসুখ নেই, টাকা পয়সার অভাব নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে – তখন কিন্তু তারা এইসব প্রশ্ন করে আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে না। বরং যখনই তার কোন সমস্যা হয়, তার পরিবারের কারো বিপদ হয়, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ধরা পড়ে, তখনই তাদের এই সব প্রশ্ন শুরু হয়। মানুষের মত একটা নগণ্য বুদ্ধির প্রাণী, যারা এখন পর্যন্ত পদার্থের ‘ভর’ কেন হয় – এরকম অত্যন্ত প্রাথমিক একটা ব্যপার বের করতে পারেনি; যেই ‘হিগ্স বোসন’ বের করার জন্য ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে গবেষণা করছে এক যুগ ধরে, তারাই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অচিন্তনীয়, অকল্পনীয় সৃষ্টিকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে। এরকম মূর্খসম একটা প্রাণী,যাকে আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট আখ্যায়িত করেছেন,সেই দাবি করে – আল্লাহ বলে কিছু নেই, থাকলে পৃথিবীতে এত অশান্তি, এত দুঃখ, কষ্ট, যুদ্ধ, থাকতো না।
কিন্তু আপনি এসব কিছুই মানতে পারছেন না। আপনি বলবেনঃ
“আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠাবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করল না কেন আমি এরকম জীবন চাই কিনা?”
যারা এধরনের প্রশ্ন করে তারা আসলে চিন্তা করেই দেখেনি কি রকম অবান্তর একটা প্রশ্ন এটা। আল্লাহ কি প্রতিটা মানুষের আত্মাকে জন্ম হবার আগে একটা ঐশ্বরিক ফুটেজ ছেড়ে দিয়ে বলতেন, “দেখ, এই হচ্ছে তোমার হবু বাবা-মা। তাদের অবস্থা দেখে তোমার যদি পছন্দ হয়, তাহলে আমাকে জানাও, আমি তোমাকে তাদের সন্তান করে পৃথিবীতে পাঠাব।”
ধরুন আপনার বাবাকে এই সুযোগটা দেওয়া হয়েছিল। তিনি ‘না’ বলেছিলেন কারণ আপনার দাদা-দাদিকে তার পছন্দ হয় নি। যে কারনে আপনার বাবার জন্ম হয়নি। তাহলে আপনি আসবেন কোথা থেকে?
এভাবে পেছনের দিকে যেতে থাকেন। আপনার বড় দাদা, তার বাবা, তার বাবা। কেউ একজন যদি বলতেন, ”না, আমার বাবা-মাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না, আমি যাবো না” – তাহলে পুরো একটা প্রজন্মের কোন দিন জন্ম হত না। আপনি কোন দিন সেই সুযোগটা পেতেন না। আপনার আত্মাকে বলা হত – “যেহেতু তোমার বাবা পৃথিবীতে যেতে চাচ্ছে না, সেহেতু তোমার পৃথিবীতে যাবার কোন সুযোগ নেই।” তখন কি আপনি দাবি করতেন না – “কেন? আমার বাবা না গেলে আমি সুযোগ পাব না কেন? এটা অন্যায়!”
এ পর্যায়ে আমাকে একজন বলেছিলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি পৃথিবীতে আসব, কি আসব না সেটা না বলে, আমাকে আমার পছন্দ মত বাবা-মা দেওয়া হল না কেন?”
ব্যপারটা কিভাবে ঘটত চিন্তা করে দেখেছেন কি? আল্লাহ কি আপনাকে একটা ঐশ্বরিক প্রগ্রাম এবং একটা ঐশ্বরিক রিমোট দিয়ে বলতেনঃ
“যাও, এই প্রগ্রামে পৃথিবীতে এখন যে কোটি কোটি বাবা-মা আছে, তাদের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নাও। এই রিমোটটা দিয়ে প্রতিটা ওয়েবে একটা করে বাবা-মার জীবন বৃত্তান্তফুটেজ সহ দেখতে পারবে। তোমার দেখা শেষ হলে আমাকে বল কোন ওয়েবের বাবা-মার সন্তান হতে চাও তুমি।”
তাহলে এই সুযোগ শুধু আপনাকে না, প্রতিদিন যে লক্ষ লক্ষ বাচ্চা জন্ম হয় তাদের প্রত্যেকের আত্মাকে একই সুযোগ দিতে হবে। তাহলে ঘটনা কি দাঁড়াবে? প্রতিদিন হাজার হাজার আত্মা আল্লাহকে গিয়ে বলবে, “আমি বিল গেটসকে আমার বাবা হিসেবে চাই”।
প্রতি দিন সকালে বিল গেটসের স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস ঘুম থেকে উঠে দেখবেন, তার সামনে হাজার হাজার আত্মার বায়োডাটা পড়ে আছে ,আর তিনি যেহেতু খ্রিষ্ট ধর্মের বিশ্বাসী বলে সেহেতু প্রতিটি বায়োডাটাতে যিশু খ্রিষ্টের সুপারিশ দেখতে পাবেন এবং তাকে বলতে হবে কাকে তিনি নিজ সন্তান হিসাবে জন্ম দিতে চান। তিনি যাদেরকে না বলবেন, তাদের আত্মার কাছে খবর চলে যাবে অন্য কোন বাবা-মা খুঁজে বের করতে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে এবং যেই আত্মাগুলোর কপালে আফ্রিকার কোন গরিব বাবা-মা পড়বে, সে বলবে, “আমার কপালে এরকম বাবা-মা পড়ল কেন? কেন বিল গেটসকে আমার বায়োডাটা আগে দেওয়া হল না?”
তখন আমাকে যিনি এই প্রশ্নগুলো করছিলেন বললেন, “আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানাল কেন? আমাকে তো অন্তত এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পারত?”
তাহলে শুধু আপনাকে না, আজকে যে লাখ খানেক মেয়ে বাচ্চা জন্ম নিবে, তাদের সবাইকে এই সুযোগ দিতে হবে। তখন দেখা যাবে আজকে সবগুলো ছেলে বাচ্চা জন্ম হল। কালকেও সব ছেলে হল। এভাবে এক বছর ধরে শুধুই ছেলে বাচ্চা জন্মাল এবং এক প্রজন্মের মধ্যেই পৃথিবীতে সব মেয়ে শেষ হয়ে গেল এবং মানব জাতি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
আপনি যত ভাবেই চিন্তা করেন না কেন, যখনি আপনি স্বার্থপর চিন্তা না করে, সবার জন্য সমান ভাবে কাজ করে এরকম কোন নিরপেক্ষ ব্যবস্থা চিন্তা করে বের করবেন, দেখবেন আল্লাহ আমাদেরকে যেভাবে বানিয়েছেন, সেটাই সবচেয়ে নিরপেক্ষ ব্যবস্থা।এ ছাড়া আর কোন ভাল ব্যবস্থা হতে পারে না।
সুতরাং আল্লাহ যে সবচেয়ে নিরপেক্ষ, সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ, সবচেয়ে সুবিচারক সত্তা এবং তিনি যে প্রতিটি মানুষকে তার প্রতিটি কষ্টের জন্য যথাযথ প্রতিদান দিবেন – আপনি সেটায় সম্পূর্ণ আস্থা রাখুন। আপনি যদি মেয়ে হন, তাহলে আপনার মেয়ে হবার কারণে জীবনে যত জটিলতা হয়েছে, যা আপনি ধৈর্য ধরে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে, বিশ্বাসকে অটুট রেখে পার করেছেন, তার প্রত্যেকটার জন্য আপনার পরকালের হিসাব কম দিতে হবে এবং আপনি তত সহজে বেহেশতে যাবেন। ছেলেদের পরকালের হিসাব হবে আপনার থেকে অনেক অনেক কঠিন। যারা এই পৃথিবীতে যত আরামে থাকবে, যত সুযোগ সুবিধা পাবে, তাদেরকে তার জন্য বরং তত বেশি জবাব দিতে হবে।দেখবেন মেয়ে হিসাবে আপনার জীবন স্বার্থক হবে ।অনেক ছেলের চেয়ে আপনার জীবন কাময়াব হবে।
‘আমি’ তোমাদেরকে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, এবং সম্পত্তি, জীবন ও ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। তবে (মুহম্মদ) ধৈর্যধারণকারীদের সুসংবাদ দিন। যাদেরকে দুর্ঘটনা/বিপর্যয়/কষ্ট আঘাত করলে বলে, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং তাঁর কাছেই আমরা ফেরত যাব।” [আরবিঃ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন] তাদের উপরেই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ এবং দয়া রয়েছে এবং তারাই সঠিক পথে আছে। (২:১৫৫-১৫৭)
যারাই জীবনে পরীক্ষায় পড়ে আল্লাহকে দোষ না দিয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিবে এবং ধৈর্য ধরবে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সুতরাং চলুন আমরা বেশি করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলো ধৈর্য নিয়ে পাস করার সামর্থ্য দেন।
আরেকটি ব্যপার মনে রাখবেন, আল্লাহ আপনার ভালোর জন্য অন্য কোন বৃহত্তর স্বার্থ ত্যাগ করেন না। কারণ সেটা মানুষের দৃষ্টিতেই অন্যায় হয়ে যাবে। বরং তিনি বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ত্রুটি গুরো দূর করেন,যা আমরা ক্ষতি বলে মনে করি ।জীবনে এমন ক্ষুদ্র ক্ষতি হতে পারে– যার একজন ভুক্তভুগি আপনি হতে পারেন।এতে হতাশ হয়ে যাওয়া উচিত নয়। যেমন শেষ নবীর (সা) ছেলে সন্তান হয়ে মারা গিয়েছিল। একজন নবী, যাকে কিনা আল্লাহ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, তাকে কিভাবে তিনি সন্তান মারা যাবার মত নিদারুন কষ্ট দিতে পারেন? তিনি কি তার সন্তানকে সহি সালামতে জীবীত রাখতে পারতেন না? তিনি কি তার ছেলে সন্তানটিকে অলৌকিকভাবে বাঁচাতে পারতেন না? কত নবীকে তিনি অলৌকিক ভাবে সাহায্য করেছেন! এধরণের ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর ক্ষতি করেন, সেটা নবী হোক, সাধারণ মুসলমান হোক, আর কোন কাফির হোক,খ্রিষ্টান হোক,হিন্দু হোক বা বুদ্ধ হোক। কু’রআনের সব অলৌকিক ঘটনাগুলো পড়লে দেখবেন যখনই মানব জাতির ব্যপক ক্ষতি হতে থাকে এবং সেটা না আটকালে মানবজাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তখনি আল্লাহ অলৌকিক ঘটনা ঘটান। যেন তেন কারণে তিনি তাঁর নিজের বানানো পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম, মহাবিশ্ব পরিচালনার আইন তাঁর কর্তৃক প্রবর্তিত জগতের নিয়ম ভাঙ্গেন না – আগুনকে ঠাণ্ডা হতে বলেন না, নদীর পানিকে রক্তাক্ত করে দেন না, আকাশ থেকে উল্কা বৃষ্টি করেন না। সুতরাং যখন আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে, ধরে নিবেন এর একটা কারণ হতে পারে যে আল্লাহ বৃহত্তর স্বার্থে আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করেছেন এবং আপনার ক্ষতির যথাযথ প্রতিদান অবশ্যই আপনি পাবেন। শেষে আবারো বলব, যারা এধরণের প্রশ্ন করে তাদের আসল সমস্যা হচ্ছে তারা বুঝতে পারেনি প্রভুর সংজ্ঞা কি। আপনি প্রভু এবং দাস প্যারাগুলো বার বার পড়ুন।
“আল্লাহর মানুষ বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে এতো কষ্ট দেবার কি দরকার ছিল? সরাসরি মানুষকে বেহেস্তে পাঠালেই তো হয়ে যেত?”
তাহলে যারা দোযখে যাবে তারা কি জিজ্ঞেস করবে না, “কেন আমাকে দোযখ দেওয়া হল? আমি কি অপরাধ করেছি?” যারা বেহেস্তে যাবে, তারা কি দাবি করবে না, “কেন আমাকে বেহেশতে ৫০,০০০ একর বাগান দেওয়া হল, কেন ১,০০,০০০ একর বাগান দেওয়া হল না?”
মানুষকে যদি আল্লাহ কোন শাস্তি দেন, তাহলে এটা স্বাভাবিক যে আল্লাহ মানুষকে সেই শাস্তি পাবার কারণ কি সেটা দেখাবেন। তা না হলে মানুষ দাবি করবেই কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হল। আল্লাহ যদি মানুষকে পৃথিবীর জীবনের সুযোগটা না দিয়ে জাহান্নামের কষ্টের পরিবেশ বানিয়ে, তাতে সরাসরি মানুষ ভরে দিতেন – তাহলে মানুষ কি বসবাস করতে পারত?
একই ভাবে মানুষ যখন বেহেশতে যাবে, তার দাবি থাকবে তাকে বেহেশতে যা দেওয়া হয়েছে তা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। কেন সে কম পেল তার বেহেশতের অপর প্রতিবেশীর থেকে? কেন সে যা পেয়েছে তার থেকে আরো বেশী কিছু পেল না? মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দাবি করবে আল্লাহ কিসের ভিত্তিতে তাকে বেহেশতে সেসব দিয়েছে। একারণেই মানুষকে পৃথিবীর জীবন দেওয়া হয়েছে যেন মানুষ বেহেশতে যা কিছু পাবে, তা সে নিজে পৃথিবীতে অর্জন করে যেতে পারে।
এগুলো সবই হচ্ছে যুক্তি নির্ভর উত্তর। আল্লাহই ভালো জানেন তিনি কেন পৃথিবী বানিয়েছেন। যারা এধরনের প্রশ্ন করে তাদের প্রথম সমস্যাই হচ্ছে আল্লাহ এবং তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। আগে সেটা ঠিক করা দরকার।
আরেকটা ব্যপার হল, আপনি ধরেই নিচ্ছেন মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে শুধুই কষ্ট করার জন্য?এটি প্রচলিত ভুল ধারণা। আল্লাহ তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকে নিয়ে কু’রআনে অনেক গর্ব করেছেন। তিনি মানুষকে বার বার বলেছেন পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে, তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকে উপভোগ করতে, পৃথিবীতে পরিমিত উপভোগ করে সুন্দর জীবন যাপন করে পরকালে আরও আনন্দের জন্য চেষ্টা করতে। আল্লাহ কতবার তাঁর সৃষ্ট সুস্বাদু ফলমূলের কথা কু’রআনে বলেছেন, যেন আমরা সেগুলো উপভোগ করি। কতবার তিনি তাঁর সৃষ্ট অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলেছেন, যেন আমরা সেগুলো ঘুরে দেখি। কতবার তিনি পৃথিবীতে কত আনন্দের উপকরণের কথা বলেছেন, যেন আমরা সেগুলো পাবার চেষ্টা করি। এমনকি আমরা কিন্তু নামাযে দোয়াও করিঃ
রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও,…
ও আমাদের প্রভু, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন, এবং আমাদেরকে আখিরাতেও কল্যাণ দিন (২:২০১)
আল্লাহ আমাদেরকে প্রথমেই দুনিয়াতে কল্যাণ প্রার্থণা করতে বলেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য যদি থাকতো দুনিয়াতে একটা বন্দি, কষ্টের জীবন দেবার, তাহলে তিনি আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ না চেয়ে শুধুই চুপ করে ধৈর্য ধরে থাকতে বলতেন। কু’রআনে বহু আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে দেশ বিদেশ ঘুরতে বলেছেন, তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকে উপভোগ করতে বলেছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবনকে সমৃদ্ধ করতে বলেছেন। আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে শুধুই কষ্ট দেওয়াটা তার উদ্দেশ্য নয়।
আল্লাহ অনুগ্রহ করে যা দিয়েছেন তা নিয়ে যারা কৃপনতা করে আর ভাবে সেটাই তাদের জন্য ভাল, না, বরং সেটা তাদের জন্য খুবই খারাপ। … (৩:১৮০)
সুতরাং আপনি কৃপনতা করে টাকা জমিয়ে রেখে একটা নিম্ন মানের জীবন যাপন করে যদি মনে করেন আপনি ভাল কাজ করছেন, তবে সেটা ভুল। কিয়ামতের দিন আপনার সেই জমানো সম্পদ আপনার ঘাড়ে পেছিয়ে দেওয়া হবে।
এখন আপনি মনে করেন, আপনার জীবনের সব কষ্টের জন্য আল্লাহ দায়ী। আপনার কষ্টের পেছনে আপনার, আপনার বাবা-মার, আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানি, মামা, চাচা, খালু, দেশের প্রধানমন্ত্রী কারও কোন হাত নেই। ভুল ধারণা। আপনি গরীব তার কারণ আপনার বাবা-মা তাদের জীবনে ভুল করেছেন। আল্লাহর দেওয়া অনেক সুযোগ হেলা করে ছেড়ে দিয়েছে, কিপটামি করেছে। তারা আরেকটু বেশি চেষ্টা করলেই জীবনটা তাদের এবং আপনার জন্য অনেক সুন্দর করতে পারতো। কিন্তু তা না করে ঘরে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখেছেন, প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে রাজনীতি আর শাড়ি নিয়ে গল্প করে আল্লাহর দেওয়া মূল্যবান সময়, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা, প্রতিভা এবং ক্ষমতা নষ্ট করেছেন। একই ভাবে আপনার জীবনটা আজকে এত কঠিন এবং কষ্টের তার কারণ আপনার দাদা একটু চেষ্টা করলেই একটা জমি চাষ না করে আল্লাহ তাকে যে আরেকটা জমি চাষের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেটা করে তিনি নিজের জন্য একটা বাড়ি করে ফেলতে পারতেন এবং আপনার বাবা তখন পড়াশুনা করে, ভালো চাকরি করে, তার নিজের জন্য আরেকটা বাড়ি কিনতে পারতেন – তাহলে আপনার তখন কোন অভাব থাকতো না। বাংলাদেশের প্রাক্তন শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রীকে আল্লাহ দশ বছর আগে বিনামূল্যে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পাবার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার লোভের জন্য সেই সুযোগ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি যদি সেই সুযোগটা নিতেন, তাহলে আজকে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের চাকরি থাকতো এবং লক্ষ লক্ষ পরিবার সুখী, সচ্ছল জীবন পার করতে পারতো। তাদেরকে দোষ না দিয়ে আপনার জীবনের সব সমস্যা, দুঃখ, কষ্টের জন্য শুধু আল্লাহকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আল্লাহ তো আপনার বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, প্রধানমন্ত্রীকে বিবেক-বুদ্ধি, সুযোগ, সামর্থ্য সবই দিয়েছিলেন।
আপনার যদি মনে হয়, আমার বাবা-মার কোনই উপায় ছিলনা তাদের অবস্থার পরিবর্তন করার, আল্লাহ তাদেরকে এমন কঠিন অবস্থায় রেখেছিলেন যে তাদের সেখান থেকে বের হবার কোন উপায়ই ছিল না, তাহলে আপনি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা, স্টিফেন হকিং এর জীবনী পড়ে দেখেন। অসম্ভব অবস্থার মধ্যে থেকেও তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে গেছেন। আপনার বাবা-মা কু’রআন পড়ে বুঝে আল্লাহর আদেশ মেনে চললেই তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারতেন। খুব সম্ভবত তারা জীবনে একবারও পুরো কু’রআন বুঝে পড়েন নি এবং আপনিও হয়তো এখনও পুরো কু’রআন বুঝে পড়ে তার ১০% নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন নি।অথবা কুরআন পড়েননি, কুরআনের বানী বুঝেননি। আর আপনিই কিনা আল্লাহকে দোষ দিচ্ছেন আপনার দুরবস্থার জন্য!
আর আপনি যদি ভাবেন – “এখানে আমার দোষ কি? অন্যের ভুলের জন্য আমাকে কেন পস্তাতে হবে?” তাহলে আপনি কি আশা করেন – আল্লাহ আপনাকে জন্ম দিবে গাছের মত পাতা দিয়ে, যাতে করে আপনি সূর্যের আলো থেকে সালোক সংশ্লেষণ করে খাবার তৈরি করতে পারেন, আপনাকে খাবারের জন্য কষ্ট করে চাকরি করতে না হয়? নাকি আপনাকে জন্ম দিবে আটলান্টিক সাগরের অতল গভীরের কোন অজানা জলজ প্রানী হিসাবে যেখানে হীরা জহতে সোনা তার তাল পাওয়া যায়!অথবা আপনার কান থেকে ঘন তরল সোনা বের হবে যা বিক্রি করে আপনি বাড়ি, গাড়ি কিনে ফেলতে পারবেন? না কি আল্লাহর উচিৎ ছিল আপনার বাবা-মার প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়ার, যাতে করে তারা সন্তান না পাবার দুঃখে সারা জীবন আল্লাহকে দোষ দিতে না পারেন?
আরেকটা ব্যপার হচ্ছে, মানুষ স্বভাবতই অলস। তাকে অভাব, কষ্ট না দিলে, একটু ধাক্কা না দিলে সে সাধারণত কোন ঝুঁকি নিতে চায় না। আর ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছু পাওয়া যায় না। আল্লাহ অনেক সময় আপনাকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কষ্ট, সমস্যা দেন আপনাকে সেই ধাক্কাটি দেবার জন্য যাতে করে আপনি যে ভুল দিকে যাচ্ছিলেন সেদিকে না গিয়ে সঠিক দিকে যান, নিজের জন্য এবং নিজের পরিবার, সন্তান, প্রতিবেশী, সমাজ, দেশের জন্য একটা বড় কিছু করেন। অনেক সময় আল্লাহ আপনাকে কষ্ট দেন আপনাকে সাবধান করার জন্য, যে আপনি একটা বড় পাপ কাজ ক্রমাগত করে যাচ্ছেন এবং আপনার নিজেকে সংশোধন করা উচিত।
“সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন? মুসলমানরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি? সব টেররিস্টগুলো মুসলমান কেন? কেন ধর্মের নামে এতো খুনাখুনি, যুদ্ধ? আল্লাহ কেন শয়তানকে বানালো? শয়তান না থাকলে তো আমরা সবাই বেহেস্তে যেতে পারতাম। আল্লাহ কি জানে না কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি? আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি? আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন? এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো অন্যায়।”
“আল্লাহ আমাকে কেন বানিয়েছে? আমি কি আল্লাহকে বলেছিলাম আমাকে বানাতে? আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠাবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করল না কেন আমি এরকম জীবন চাই কিনা?“
“আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্টের জীবন দিল, যেখানে অন্যরা কত শান্তিতে আছে? আমি কি বলেছিলাম আমাকে এতো কষ্ট দিতে?”
“আল্লাহ আমাকে মেয়ে বানালো কেন, আমিতো মেয়ে হতে চাইনি? আল্লাহ আমাকে কালো কিন্তু অন্যদেরকে ফর্সা বানাল কেন, এটা তো ঠিক হল না? আমি খাট কেন, লম্বা না কেন? আমার কপালে এরকম শয়তান স্বামী পড়ল কেন? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি, রোযা রাখি, কোনদিন ঘুষ খাইনি, কিন্তু তারপরেও আমার ক্যান্সার হল কেন?”
আমি এবার ‘দার্শনিক ক্যাটাগরির’ জটিল প্রশ্ন গুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করি।
“সত্যিই যদি আল্লাহ থাকে তাহলে পৃথিবীতে এতো দুঃখ, কষ্ট কেন?”
আপনার যদি এই ধারণা থাকে যে – সত্যিই যদি কোন ‘পরম করুণাময়’ সৃষ্টিকর্তা থাকতো, তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, কষ্ট, যুদ্ধ, অভাব, অসুখ থাকতো না – তার মানে এই না যে কোন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা নেই। এর মানে এটাই যে আল্লাহ কি উদ্দেশে পৃথিবী তৈরি করেছেন, তা আপনি বুঝতে পারেন নি। পৃথিবীতে কোন সমস্যা থাকার মানে এই না যে কোন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা নেই বরং এটাই প্রমাণ হয় যে আপনি সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা সম্পর্কে নিজে নিজেই কিছু একটা ধারণা করে নিয়েছেন, যা সঠিক না। একটা পিঁপড়া যদি মানুষকে চ্যালেঞ্জ করে – “তোমাদের না এত বুদ্ধি? তাহলে তোমরা মাটির উপরে বাড়ি বানাও কেন? আমাদের মত মাটির নিচে থাকলেই তো পারো?” এখানে পিঁপড়া ধরে নিচ্ছে বুদ্ধিমান হলেই মাটির নিচে থাকতে হবে, যা পিঁপড়ার কাছে সহজাত হলেও আমাদের কাছে হাস্যকর। ঠিক একই ভাবে এটা হাস্যকর যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার এক সংজ্ঞা নিজে নিজে বানিয়ে, সেই সংজ্ঞা ব্যবহার করে নিজেরাই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন।
দ্বিতীয়ত, আপনাকে কে শেখাল করুণা কি? পৃথিবীতে যদি কোন সমস্যা না থাকতো, কোন অন্যায় না হত, কোন খারাপ কিছু না থাকতো, তাহলে আপনি বুঝতেন কি করে ‘খারাপ’ কি এবং তখন ‘ভালো’ বলতেই বা কি বোঝাতো? আলো বলে অন্দকার তুমি বড় কালো ?করুণা করার প্রশ্ন তখনই আসে যখন কোন মন্দ ঘটনা ঘটে। কোন মন্দ না থাকলে তো করুণার অস্তিত্ব থাকতো না। বরং আপনার মনে করুণার ধারনাটি যে আছে সেটাই তো প্রমাণ করে যে কেউ একজন আছে যে আপনাকে করুণার ধারনাটি দিয়েছে! না হলে এই ধারণাটি আপনার মনে আসলো কিভাবে? এটা তো ক্ষুধার মত কোন শারীরবৃত্তীয় ধারণা না যে,আপনার খুদা লেগেছে,খাওয়া জরুরী অথবা আপনি বিবর্তনের মাধ্যমে বানর থেকে মানুষ হবার সময় এই ধারণাটি পেয়েছেন!?
তৃতীয়ত, আল্লাহ পরম করুণাময় হলেই যে তিনি কাউকে কোন অন্যায় করতে দিবেন না, তা আপনাকে কে বলেছে?মহান আল্রাহ আপনাকে বিবেক বুদ্ধি দিয়ে সৃজন করেছেন।যেমন- বাবা-মা তাদের বাচ্চাদেরকে অত্যন্ত ভালবাসে, কিন্তু তাই বলে তারা নিশ্চয়ই তাদের বাচ্চাদের চিন্তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না এবং প্রত্যেকটা কাজে বাধা দেয় না। বাচ্চারা অন্যায় করে, তারপর তার জন্য শাস্তি পায়। বাবা-মা সবসময় চেষ্টা করে বাচ্চাদেরকে যতটুকু সম্ভব ভুল না করতে দেওয়ার, অন্যায় থেকে দূরে থাকার জন্য উপদেশ দেবার। আল্লাহও সেটাই করেন আমাদের সাথে।
চতুর্থত, আপনি ধরে নিচ্ছেন, পৃথিবীতে যাবতীয় দুঃখ কষ্টের জন্য শুধু আল্লাহ দায়ী। এখানে মানুষের কোন হাত নেই। মানুষের হাত থাকলেও কেন আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করলো না যার জন্য মানুষ যেন কখনও অন্য মানুষকে কষ্ট দিতে না পারে। আমরা অনেক সময় ঠিকভাবে সময় নিয়ে চিন্তা করে দেখিনা আমরা আল্লাহকে কি নিয়ে দোষ দেই। যেমন আপনি হয়তো আফ্রিকার গরিব মানুষদের কষ্ট দেখে ভাবছেন কেন আল্লাহ তাদেরকে এত কষ্ট কেন দেয়? আল্লাহ আফ্রিকার দেশগুলোকে অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাদের তেল ছিল, হীরা ছিল, সোনা ছিল। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তাদের ব্যবসায়ী সরকার নিজেদের সুখের নিমিত্ত পকেটে টাকা ঢোকাবার জন্য পশ্চিমা দেশের কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করে সব তেল, গ্যাস, হীরা, সোনা পশ্চিমা দেশে পাচার করে দিয়েছে।দেশের বা আপন জনগনের কথা ভাবেনি । যার ফলে নিজের দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে দেশের মানুষগুলো চরম গরিব হয়ে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আফ্রিকার গরিব দেশগুলোর সরকারগুলো যদি নিজেদের দেশ ও জনগণের কথা ভাবতো পররাষ্ট্র নীতিতে স্বচ্ছ এবং দক্ষ হত, তারা নিজেদের কমিশনের কথা চিন্তা না করে দেশের মানুষের জন্য ভাবতো, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে গোপন রাখত, যতক্ষণ না তারা নিজেদের দেশে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে সেই প্রাকৃতিক সম্পদগুলো নিজেরাই উপযুক্ত দামে বিক্রয় করতে না পারছে, তাহলে আজকে তাদের এই অবস্থা হত না। আল্লাহ সমস্ত দেশগুলোকে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়েছিলেন, যেরকম কিনা তিনি মালয়েশিয়াকে দিয়েছেন। কিন্তু মালয়েশিয়া তাদের দেশ ও জনগণের কথা ভেবেছে, সম্পদকে নিজের দেশে রেখে নিজেরাই তার উপযুক্ত মূল্য আহরণ করে বিরাট বড় লোক হয়ে গেছে। অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলোর রাষ্টের ক্ষমতাবানেরা দেম জনগণের স্বার্থের কথা ভাবেননি রাষ্টের কর্ণধাররা নিজেদের একান্ত লাভের কমিশনের বিনিময়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সেই প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়ে দেশকে ফকির করে ফেলেছে।
আল্লাহ কখনও কোন জাতির উপরে দেয়া তাঁর অনুগ্রহকে বদলান না, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেদেরকে বদলিয়ে না ফেলে। (৮:৫৩)
এখন আপনি দাবি করবেন, “আল্লাহ তাহলে তাদেরকে এমন সরকার হতে দিল কেন? কেন সেই সরকারের সদস্যগুলোর মাথায় বাজ পড়লো না,তারা ধ্বংশ হয়ে গেল না ? যখন তারা বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করে নিজের দেশকে বিক্রি করে দিচ্ছিল? কেন বিদেশি দেশগুলোকে আল্লাহ টর্নেডো, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দিয়ে তাদের লাভের লুটতরাজকে আটকিয়ে রাখল না, যাতে করে তারা আফ্রিকাতে গিয়ে সম্পদগুলো কুক্ষিগত করতে না পারে?” সমস্যা হচ্ছে আপনি চাচ্ছেন পৃথিবীর মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যায় করে যাবে, আর আল্লাহ অলৌকিক ভাবে প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় করা থেকে আটকিয়ে রাখবেন। যদি আল্লাহ তাই করতেন তাহলে এই পৃথিবী তৈরি করে মানুষকে পাঠিয়ে পরীক্ষা নেবার কোন দরকার ছিল না, যদি তাঁর উদ্দেশ্যই থাকতো মানুষকে যেভাবেই হোক অন্যায় করা থেকে আটকিয়ে রাখার। মানুষ অন্যায় করবে, তার জন্য শাস্তি পাবে। মানুষের অন্যায়ের কারণে যারা ভুক্তভূগি, তাদের সাথে আল্লাহ যথার্থ ন্যায় বিচার করবেন এবং তাদের কষ্টের জন্য যথাযথ প্রতিদান দিবেন।আর আর অন্যায়কারী জুলুমকারীকে শাস্তি দিবেন।মনে রাখবেন, আল্লাহ হচ্ছেন ‘পরম ন্যায় বিচারক’ – তিনি সামান্যও অন্যায় করেন না। সুতরাং মানুষের কষ্ট দেখে আল্লাহর উপর ভরসা হারিয়ে না ফেলে আল্লাহর গুণ গুলো নিয়ে ভালভাবে চিন্তা করুন। আপনার মনে আল্লাহর সম্পর্কে যত ধরণের সংশয়, দ্বিধা, সন্দেহ আছে, তা চলে যাবে। কু’রআন নিজে মনোযোগ দিয়ে বুঝে পড়লেই এধরনের সংশয়ের সমাধান পেয়ে যাবেন। যখনি মনে কোন সন্দেহ জাগবে, সেই সন্দেহের উত্তর খোঁজার জন্য কু’রআন পড়া শুরু করবেন। দেখবেন আল্লাহ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রেখেছেন। সবসময় মনে রাখবেনঃ
আল্লাহ কখনই মানব জাতির কোন ক্ষতি করেন না, বরং মানুষরাই মানুষের ক্ষতি করে। (১০:৪৪)
কিছুদিন আগে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আল্লাহ কেন গরিব মানুষগুলোকে মান্না এবং সালওয়া পাঠায় না, যে রকম কিনা অতীতে আজকের ওই বদ ইহুদিগুলোকে দিয়েছিল।” এ ধরণের অলৌকিক ঘটনা ঘটলে তার ফলাফল কি ভয়াবহ হবে চিন্তা করে দেখুন। ধরুন বসনিয়াতে নির্যাতিত মুসলিমদের উপর একদিন হঠাৎ করে আকাশ থেকে মান্না এবং সালওয়া আসা শুরু হল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই খবর ইন্টারনেটএ ছড়িয়ে যাবে এবং বিবিসি, সিএনএন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি চ্যানেল থেকে শত শত হেলিকপ্টারে করে হাজার হাজার সাংবাদিক গিয়ে সেখানে হাজির হবে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সারাদিন বসে টিভিতে দেখতে থাকবে এই অসম্ভব ঘটনা। সাড়া পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অলৌকিক ঘটনা নিজের চোখে দেখার জন্য প্লেনে করে বসনিয়াতে যাবার জন্য বিরাট লাইন দিয়ে দিবে। বসনিয়ার আসে পাশের দেশগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ গরু, ঘোড়া, গাধায় করে রওনা দিবে বসনিয়ার উদ্দেশে এই বিনামুল্যে পাওয়া খাবারে ভাগ দেবার জন্য। কয়েক দিনের মধ্যে পৃথিবীর একটা বড় জনগোষ্ঠী বসনিয়াতে গিজ গিজ করতে থাকবে। বসনিয়ার বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে কোন জায়গা পাওয়া যাবে না। শহরের পানি, খাদ্য, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি আলেমদের মধ্যে বিরাট ঝগড়া লেগে যাবে যে এই অলৌকিক ঘটনার জন্য কে দায়ী – আল্লাহ, নাকি যীশু, নাকি ইহুদিদের খোদা এল্লাহি। কয়েকদিনের মধ্যে পশ্চিমা দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের আর্মিকে হাতিয়ে, বসনিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট বানিয়ে কাটা তারের বেড়া দিয়ে সবাইকে বের করে দিবে, মান্না এবং সালওয়া নিয়ে গবেষণা এবং ব্যবসা করার জন্য।
আল্লাহ জানেন এ ধরণের কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটালে মানব জাতির লাভের থেকে ক্ষতি হবে। একারণেই তিনি তা করেন নাঃ
অলৌকিক নিদর্শন পাঠাতে আমার কোন বাঁধা নেই, কিন্তু আগের প্রজন্মগুলো সেগুলো অমান্য/অস্বীকার করেছে। আমি থামুদের লোকদেরকে পরিস্কার নিদর্শন হিসেবে এক উট দিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও তারা সেটার সাথে অন্যায় করেছিল। আমি অলৌকিক নিদর্শন পাঠাই মানুষকে শুধুমাত্র সাবধান করতে। (১৭:৫৯)
“আল্লাহ কেন শয়তানকে বানালো? শয়তান না থাকলে তো আমরা সবাই বেহেস্তে যেতে পারতাম”
আসলে প্রশ্নটা হচ্ছে, আল্লাহ কেন “মন্দ” সৃষ্টি করলো? কেন শুধুই ‘ভালো’ থাকলো না?
প্রশ্ন হচ্ছে যদি মন্দ না থাকে, তাহলে আপনি বুঝবেন কি করে ভালো কি? যদি অসুন্দর না দেখে থাকেন, তাহলে সুন্দর দেখলে তা বুঝবেন কি করে যে সেটা সুন্দর? যদি কখনও কষ্ট পেয়ে না থাকেন, তাহলে আরাম কি সেটা বুঝবেন কি করে? যদি অসুস্থতা না থাকে, সুস্থতা অনুভব করবেন কিভাবে?
সুখ হচ্ছে দুঃখের অভাব। যখন আমরা কম দুঃখে থাকি, তখনি আমরা সুখ অনুভব করি। আমাদের দুঃখ কখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় না।
একবার রোবট বানানোর সময় বিজ্ঞানীরা চিন্তা করছিলেন, কিভাবে রোবটকে সুখের অনুভুতি দেওয়া যায়? তারা চিন্তা করে দেখলেন, রোবটকে সবসময় কোন একটা কষ্ট দিতে হবে, যাতে করে রোবট চেষ্টা করবে সেই কষ্টটা কমানোর, কারণ কষ্ট কম মানেই ‘সুখ’। যখনি রোবট বুঝবে এই কাজটা করলে তার কষ্ট কমে যায়, তখনি সে ‘সুখ’ পাবার জন্য সেই কাজটা বেশি করে করবে। এজন্য বিজ্ঞানীরা রোবটের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ‘কষ্ট’ তৈরি করে তাকে ‘দুঃখে’ রাখলেন এবং তার মধ্যে সেই দুঃখ কমানোর উপায় প্রোগ্রাম করে দিলেন। রোবট তারপর সবসময় চেষ্টা করে ‘দুঃখ’ কমাবার এবং যখনি তার ‘দুঃখ’ কমে যায়, সে ‘সুখি’ অনুভব করে।
আমরা জানি সুখ হচ্ছে দুঃখের বিপরীত অনুভুতি। ধরুন আপনাকে আমি যদি বলি আমি এখন ‘কষ্টানন্দে’ আছি, আপনি কি বুঝবেন ‘কষ্টানন্দ’ অনুভূতিটা কি? যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি কষ্টানন্দ অনুভব না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি কি করে তার বিপরীত অনুভুতি ‘আনন্দুঃখ’ অনুভব করবেন? আল্লাহ যদি মানুষকে আনন্দুঃখ দিতে চান, তাহলে কি তিনি মানুষকে প্রথমে কষ্টানন্দ অনুভব করাবেন না?
আল্লাহ আমাদের উপরে একটা বিরাট অনুগ্রহ করেছেন যে আমাদেরকে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, অশান্তি খুব বেশি হলে ১২০ বছর সহ্য করতে হবে এবং তারপর আমরা হাজার বছর, লক্ষ বছর, কোটি কোটি বছর আনন্দ, সুখ, শান্তি অনুভব করবো। চলুন আমরা সেটা অর্জন করার জন্য সব রকম চেষ্টা করি। আপনাকে যদি কেউ বলে আপনাকে আজকে সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং তার বিনিময়ে আপনাকে বাড়ি, গাড়ি, জমি, টাকা সব দেওয়া হবে – আপনি কি চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে যাবেন না?
দ্বিতীয়ত, আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, যা কিছুই ভালো তা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যা কিছুই খারাপ তা হয় শয়তানের কারণে, এতে আমাদের কোন হাত নেই। ভুল ধারণা। ভালো মন্দ সবকিছুই আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন , এমনকি শয়তানও আল্লাহর সৃষ্টি,যে একদা আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিল এবং আমাদের জীবনে ভালো যা কিছু হয়, তা আল্লাহ্র অনুগ্রহে এবং যা কিছু খারাপ হয়, তা আমাদেরই দোষে, আল্লাহ্র অনুমতিতেঃ
… যখন ভালো কিছু হয়, তারা বলে, “এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে”, আর যখন খারাপ কিছু হয়, তারা বলে, “এটা তোমার (মুহম্মদ) কারণে হয়েছে।” তাদেরকে বলো, “দুটোই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে।” এই মানুষগুলোর সমস্যা কি যে তারা কিছুতেই বোঝে না তাদেরকে কি বলা হচ্ছে? তোমার উপরে ভালো যা কিছু হয়, তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, আর যা কিছু খারাপ হয়, তা তোমার কারণে। …(৪:৭৮-৭৯)
আমার অনুসারীদের উপরে তোমার (শয়তান) কোন ক্ষমতা থাকবে না , কিন্তু ওই সব পথভ্রষ্টরা ছাড়া যারা তোমাকে অনুসরণ করে। (১৫:৪২)
যখন সব ফয়সালা হয়ে যাবে (কিয়ামতের দিন), তখন শয়তান বলবে, “আল্লাহ তোমাদেরকে সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো ছিল সব মিথ্যা। তোমাদেরকে শুধু ডাকা ছাড়া আমার আর কোন ক্ষমতা ছিল না তোমাদের উপরে। তোমরাই আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিলে। তাই আমাকে কোনো দোষ দিয়ো না বরং নিজেদেরকে দোষ দাও।”… (১৪:২২)
সুতরাং অন্যায় করে বলেন না যে সব শয়তানের দোষ, শয়তান না থাকলে আপনি সেই অন্যায়গুলো করতেন না। শয়তান শুধুই আপনাকে আইডিয়া দেয়, আপনি নিজে জেনে শুনে অন্যায়গুলো করেন। আপনার সিদ্ধান্তের স্বাধীনতার অপব্যবহারের জন্য আপনি দায়ী, শয়তান নয়। আপনার টেবিলে একটা কম্পিউটারের ম্যাগাজিন পড়ে আছে, আর সামনে টিভিতে এমটিভি চ্যানেলে একজন শিক্ষিত, বয়স্ক, দুই সন্তানের মা, নামমাত্র কাপড় পড়ে লাফালাফি করছে। আপনি টিভি বন্ধ করে ম্যাগাজিনটা না পড়ে যদি হা করে তাকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সেটাতে শয়তানের দোষ নেই, পুরোটাই আপনার দোষ।
“আল্লাহ কি জানে না কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি? আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি?”
প্রথমত, আপনি যদি এই ধরণের প্রশ্ন করেন তাহলে আপনার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে – আপনি দোযখে যাবার জন্য সব দোষ আল্লাহকে দিতে চান। আপনি আপনার দোষের জন্য নিজে কোন দায়িত্ব নিবেন না, পুরোটাই আল্লাহর দোষ। আপনার আসল সমস্যা হচ্ছে আপনি প্রভু-দাস এই ব্যপারটি ঠিকমত বোঝেনি। আল্লাহি আপনার প্রভূ আপনি তাঁর দাস।
দ্বিতীয়ত, আপনি ধরে নিচ্ছেন আপনি জাহান্নামে যাবেনই। কে বলেছে আপনাকে যে আপনি জাহান্নামে যাবেন এবং আপনার আর ভালো কাজ করে লাভ নেই? বরং আল্লাহ বলেছেনঃ
… ও আমার বান্দারা, তোমরা যারা নিজেদের উপরে চরম অন্যায় করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহের উপর কখনও আশা হারিয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। কোন সন্দেহ নেই, তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর করুণাময়। (৩৯:৫৩)
তখন আপনি প্রশ্ন করবেন, “আমার কি পরিণতি হবে সেটা তো আল্লাহ জানেই? যদি আল্লাহ জানেই আমি দোযখে যাচ্ছি, তাহলে আর ভালো কাজ করে লাভ কি?”
এটা একটা জটিল প্রশ্ন কারণ এর সাথে ‘কদর’ বা ‘পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের’ ধারণা জড়িত। যদি একটা ছোট সারাংশ দেই তাহলে দাঁড়ায়ঃ
আল্লাহর কোন কিছু জানার অর্থ এই না যে আপনার কোন স্বাধীনতা নেই। আল্লাহ মানুষকে ‘সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা’ দিয়ে পাঠিয়েছেন। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ কিছু ব্যপার পূর্ব নির্ধারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু বাকি অনেক কিছু মানুষের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ কোন পরিস্থিতে পড়ে যদি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে তার জন্য পুরস্কার পাবে, যদি খারাপ সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তার জন্য শাস্তি পাবে। পরিস্থিতিগুলো আল্লাহ তৈরি করেন। প্রতিটি পরিস্থিতে মানুষ কতগুলো সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে পারবে সেটাও আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন। মানুষের কাজ হচ্ছে ভাল সিদ্ধান্ত গুলো নেওয়া এবং নিজের রাগ, লোভ, কামনা, বাসনা, ইগো ইতাদির বশবর্তী হয়ে অন্যায় সিদ্ধান্ত গুলো হতে বিরত থাকা।
যেই কিনা সৎ কাজ করবে, সে তা নিজের উপকারেই করবে; আর যেই কিনা অসৎ কাজ করবে, তা সে নিজের বিরুদ্ধেই করবে। তোমার প্রভু তার বান্দাদের উপরে কখনই অবিচার করেন না। (৪১:৪৬)
কিন্তু এর মানে এই না যে আল্লাহ জানেন না আমরা কি সিদ্ধান্ত নিব, বা আল্লাহ যদি জানেনই আমরা কি সিদ্ধান্ত নিব, তার মানে এই না যে আমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত পূর্ব নির্ধারিত। আমরা যখনি বলি – “আল্লাহ তো সব জানেন” – আমরা ধারণা করে নেই যে আল্লাহর জানাটা হচ্ছে অতীত কালের ঘটনা এবং যেহেতু আল্লাহ ‘অতীত কালে’ জেনে গেছেন, তার মানে বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই পূর্ব নির্ধারিত। এটা একটি ভুল ধারণা। আল্লাহ সময়ের উর্ধে। তাঁর জন্য কোন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নেই। কোন সত্তা যখন সময়ের বাইরে চলে যায়, তখন সে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই একই সময়ে দেখতে ও জানতে পারেন, একই মুহূর্তে সবকিছু জানতে পারে। সুতরাং, আমি জাহান্নামে যাবো এটা যদি আল্লাহ জানেন, তার মানে এই না যে আল্লাহর জানাটা অতীত কালে ঘটে গেছে এবং আমার আর ভালো কাজ করে কোন লাভ নেই, আমার ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত। আল্লাহ এই মুহূর্তে আমি কি করেছি, কি করবো এবং তার ফলে আমার পরিণতি কি হবে তা সব দেখতে পাচ্ছেন জানতে পারছেন। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি কি করবো, কি করবোনা, সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আল্লাহ আমাকে দেন নি।
কিভাবে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখা যায় তার একটা উপমা দেই। ধরুন আপনি সিনেমা হলে গিয়ে একটি চলচ্চিত্র দেখছেন। যেহেতু আপনি একটা একটা করে দৃশ্য দেখছেন, আপনি জানেন না সামনে কি হতে যাচ্ছে। আপনি শুধুই অতীতে কি হয়েছে জানেন এবং বর্তমানে কি দৃশ্য হচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ধরুন চলচ্চিত্রটির পুরো নির্মান কাজে আপনি জড়ি ছিলেন ,তাহলে আপনি একই সাথে, একই মুহূর্তে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই দেখতে পেতেন। আপনার কাছে তখন আর চলচ্চিত্রটি একটা একটা দৃশ্য আরাদা করে আগাতো না বরং পুরো চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠত।হয়তো শেষে আপনি ভাবতেন চলাচ্চত্রটি বাল হয়েছে অথবা কোথায় গলদ রয়েছে । এটা শুধুই একটা উপমা, আল্লাহ্ই জানেন সময় তাঁর কাছে কিভাবে কাজ করে।
এবার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের একটা উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গাড়িতে করে যাচ্ছেন। আপনি একটা রাস্তার মোড়ে এসে দেখলেন একটা রাস্তা বায়ে গেছে, আরেকটা ডানে গেছে। আপনি বায়ের রাস্তা নিলেন এবং চট্টগ্রামের বদলে সিলেটে গিয়ে পৌঁছালেন। এখন যারা রাস্তা বানিয়েছে – বিআরটিএ, তারা ভালো করেই জানে কোন রাস্তায় গেলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে। প্রত্যেকটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে কোন দিকে ঘুরলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে তারা তা সবই জানে। তার মানে এই না যে আপনি সিলেটে গিয়ে পৌঁছাবেন তা পূর্ব নির্ধারিত, কারণ বিআরটিএ ইতিমধ্যেই জানে রাস্তাগুলো সিলেটে গেছে। আপনি আপনার জীবনে যত মোড় নিবেন, তার প্রত্যেকটির পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ জানেন কারণ জীবনের রাস্তার প্রতিটা মোড় তাঁরই বানানো।
যেমন ধরুন আপনার যখন দশ বছর বয়স ছিল, আপনার স্কুলে দুজন বন্ধু ছিল। রহিম – যে একজন ভালো ছাত্র, সারাদিন পড়াশুনা করে, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে; আর রকি – যে বিরাট বড় লোকের ছেলে, যার ভিডিও গেমের অভাব নেই, সারারাত মুভি দেখে, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন – রহিম এবং রকি। আপনি রকির ভিডিও গেমের লোভকে সামলাতে না পেরে রকির পিছনে লেগে গেলেন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন সময় নষ্ট করে বেড়ালেন। স্কুল শেষ করলেন একটা বাজে রেজাল্ট নিয়ে। জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেললেন। সারাজীবন আল্লাহকে দোষ দিলেন আপনার দুরাবস্থার জন্য। বাকি জীবনটা আল্লাহর কোন নির্দেশ না মেনে, তার সাথে যুদ্ধ করে, তার নির্দেশগুলো অমান্য করে দোযখে চলে গেলেন।
আপনি যদি রকির পেছনে না ঘুরে রহিমের সাথে থাকতেন, আপনার একটা সুন্দর চরিত্র তৈরি হত, আপনি সুন্দর চিন্তা করতে শিখতেন, ঠিকমত পড়ালেখা করতেন, ভাল রেজাল্ট করে ভালো কলেজে পড়তে পারতেন। আপনার জীবনটা সফল হতো। তখন আপনি সারাজীবন আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে, তাঁর আদেশ মেনে জীবন পার করে বেহেশতে চলে যেতেন।
আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন। আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আপনি দায়ী।
আবার ধরুন আপনি রকির পেছনে লেগে ছিলেন এবং কোন মতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরেছেন আপনার বাবা-মার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত চেষ্টা করার পর। তারপর একদিন আপনার বন্ধু করিম আপনাকে এসে বলল, “দোস্ত, আমার এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম। ওদের এক দল আছে যারা সন্ধার পর ‘ইয়ে’ করতে যায়। সাংঘাতিক মজার ব্যপার নাকি। চল, আমরাও আজকে একবার ‘ইয়ে’ করে দেখি।” এখন এতদিনে আপনার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আজে বাজে বন্ধুর সাথে মিশলে জীবনে কত পস্তাতে হয়। কিন্তু তারপরেও আপনি লোভ সামলাতে পারলেন না, বন্ধুর সাথে চলে গেলেন। এর জন্য যদি আল্লাহ আপনাকে ধরে সোজা জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন, আপনি কি আল্লাহকে দোষ দিবেন?
কিন্তু ধরুন আপনি নিজে তো গেলেনই না, বরং আপনার বন্ধু করিমকেও আটকে রাখলেন। তাকে আপনার নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ভালো করে বোঝালেন। যার ফলে সে জীবনে একটা বড় ভুল করা থেকে বেঁচে গেল। নিজেকে সংশোধন করার জন্য এবং অন্য একজন মানুষের জীবনকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ খুশি হয়ে আপনাকে বেহেশত দিয়ে দিলেন।
এভাবে আল্লাহ আমাদেরকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাস্তার ব্যবস্থা করে দেন। আমাদেরকে সংশোধনের সুযোগ করে দেন। কিছু রাস্তা আপনাকে আরও খারাপ করে দিবে, আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের জীবনে আরও কষ্ট এনে দিবে। কিছু রাস্তা আপনাকে আপনার দুরবস্থা থেকে বের করে এনে জীবনটা সহজ করে দিবে। আপনি যদি আপনার গত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না পেয়ে, নিজের লোভ, ইগো, সন্মান, রাগ, অহংকারকে সংযত না করে আবারো ভুল রাস্তায় চলে যান, তাহলে এর জন্য আপনি দায়ী, আল্লাহ নয়।
আমি নিশ্চিত ভাবে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছি, সে কৃতজ্ঞ হোক আর অকৃতজ্ঞ হোক। (৭৬:৩)
এ পর্যন্ত যা বললাম তা হল মানুষের মস্তিস্ক বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে তার পক্ষে ধারণা করা সম্ভব এমন কিছু উপলব্ধি। যেহেতু ‘কদর’ ব্যপারটিই মানুষের কল্পনাতীত একটি ব্যপার, তাই মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা যত উন্নত হবে, মানুষের এই সম্পর্কে ধারণায় তত পরিবর্তন হবে। এখন পর্যন্ত আমরা এইটুকুই আন্দাজ করতে পারি। আল্লাহ্ই জানেন তিনি কিভাবে কদর সৃষ্টি করেছেন। এধরনের ব্যপার মানুষের জন্য চিন্তা করাটা কঠিন কারণ মানুষ সময়ের মধ্যে বাস করে এবং সময়ের বাইরে কোন কিছু তারা চিন্তা করতে পারেনা। আমাদের ভাষায় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এর বাইরে আর কোন শব্দ নেই। যেহেতু আমাদের ভাষায় এর বাইরে কোন শব্দ নেই, সেহেতু আমরা সময়ের বাইরে কিছু কল্পনাও করতে পারিনা।
“আল্লাহ থাকতে এতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন? এতো ভুমিকম্প হয় কেন? বন্যা হয় কেন? এতো মানুষ মারা যায় কেন?”
এক বিংশ শতাব্দীতে গত দশ বছরের গড় হিসাব করলে প্রতি বছর গড়ে ৭০,০০০ মানুষ মারা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। কিন্তু মানুষের দোষের কারণে কত মানুষ মারা যায় জানেন?
- শুধু এইডসে গড়ে বছরে ১৮ লক্ষ মারা যায় এবং ২০১০ সালে সাড়া পৃথিবীতে ৩.৪ কোটি এইডস আক্রান্ত মানুষ পাওয়া গেছে।
- ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক কঙ্গো যুদ্ধে ৩৩ লক্ষ মানুষ মারা গেছে।
- রাস্তায় দুর্ঘটনায় বছরে ১২ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই হয় মানুষের কারণে। যেমন নদীতে অপরিকল্পিত বাধ দেবার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে খরা সৃষ্টি হয়ে মানূষ ও জীবজগতের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মানুষের জীবনধারনে কষ্টের কারণ হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়। তারপর খরা থেকে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ, মহামারি। নিয়ন্ত্রণহীন গাছ উজার করার ফলে হয় অনাবৃষ্টি এবং মাটির পানি শোষণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে হয় বন্যা, নদী ভাঙ্গন। তারপর বন্যা থেকে মহামারি, দুরভিক্ষ। ফ্যাক্টরির বর্জ্য নদীতে ফেলে নদী দূষণের কারণে হয় মহামারি, খাবারের অভাব, দুর্ভিক্ষ, এবং ব্যাপক পরিবেশ দূষণ, যার কারণে মানুষের নানা ধরণের জটিল অসুখ হয়। কোটি কোটি টন মানুষের বর্জ্য নদী থেকে সমুদ্রে ফেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট, মহামারি, ক্যানসার সৃষ্টি ইত্যাদি।
আল্লাহ কখনও কোন জাতির উপরে দেয়া তাঁর অনুগ্রহকে বদলান না, যতক্ষণ না সে জাতি নিজেদেরকে বদলিয়ে না ফেলে। (৮:৫৩)
আমরা কত ভাবে প্রকৃতির ক্ষতি করি এবং প্রকৃতি প্রতিনিয়ত সেই ক্ষতি গুলোকে সংশোধন করার চেষ্টা করে ।আপনার পৃথিবী সম্পর্কে শ্রদ্ধা হাজার গুণে বেড়ে যাবে যখন আপনি দেখবেন পৃথিবীতে কত হাজার ধরণের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান দিয়ে তৈরি করে রেখেছেন মানুষের অবাধ দূষণ পরিস্কার করার জন্য। কিন্তু তারপরেও মানুষ সীমালঙ্ঘন করে এবং তার ফলাফল ভোগ করে।
মানুষের কোনই হাত নেই এমন কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল – সুনামি, ভুমিকম্প, আগ্নেয়গিরি এবং উল্কাপাত। এখন সুনামি, আগ্নেয়গিরি এবং ভুমিকম্প প্রবণ এলাকা গুলো মানুষ ভালো করেই জানে। তারা সেখান থেকে সরে গেলেই পারে। কিন্তু তারা সেটা করে না। বাপ-দাদার ভিটামাটি আকরে ধরে থাকার এক মায়ার মোহ আছেন তাদের মধ্যে। তারা ভূমিকম্পে, সুনামিতে, যুদ্ধে মারা যাবে, কিন্তু তারপরেও সেখান থেকে তারা সরে যাবেন না। তারা অমুসলিম, অত্যাচারী শাসকের অত্যাচারে জীবন পার করবে, কিন্তু আল্লাহর দেওয়া এত বড় পৃথিবীতে অন্য কোথাও গিয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে না।কারণ এটাই মানুসের সহজাত প্রবৃত্তি । আল্লাহ বলেছেনঃ
যখন ফেরেস্তারা ঐসব লোকদের আত্মাকে নিয়ে যাবে যারা নিজেদের উপরে অত্যাচার করছিল এবং জিজ্ঞেস করবে, “তোমরা কি অবস্থায় ছিলে?” তারা উত্তর দিবে, “আমরা দুর্বল/অত্যাচারিত/অসহায় অবস্থায় ছিলাম।” ফেরেস্তারা বলবে, “আল্লাহর পৃথিবী কি যথেষ্ট বড় ছিল না, তোমাদের অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য?” ঐসব লোকদের আশ্রয় হবে জাহান্নাম, এক জঘন্য গন্তব্য। কিন্তু সেসব সত্যিকারের অসহায় পুরুষ, মহিলা এবং বাচ্চারা ছাড়া ,যাদের নিজেদের কোন সামর্থ্য ছিল না এবং যাদের অন্য কোন পথও ছিল না। (৪:৯৭-৯৮)
তবে শুধু অসহায় মানুষদেরই যে সবসময় দোষ তা নয়। মানুষ তার স্বার্থপর রাজনৈতিক নিয়ম দিয়ে আল্লাহর দেওয়া পৃথিবীকে ‘দেশ’ নামের ১৯৬টা ভাগে ভাগ করে এবং আইন আর ‘ভিসা’ নামের একটি ব্যবস্থা করে এমন ব্যবস্থা করে রেখেছে যে গরিব অসহায় মানুষগুলোকে ভুমিকম্প, সুনামি প্রবণ এলাকাগুলোতে অসহায় ভাবে বন্দি থাকতে হবেই জীবনভর। আল্লাহর দেওয়া এই বিশাল পৃথিবীতে এতো খালি জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে তারা শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা হয়েছে মানুষের তৈরী আইন আর ভিসা নামক সীমাবদ্ধতায়। এর জন্য আল্লাহকে দোষ দিয়ে তো কোন লাভ নেই। মানুষ কত স্বার্থপর হতে পারে তা কিছুদিন আগে বার্মাতেই দেখা গেছে। হাজার হাজার গরীব মুসলমান গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য, দিনের পর দিন না খেয়ে সমুদ্রে ভেসে বাংলাদেশে আসলো একটু আশ্রয় পাবার জন্য, আর বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে ভিসা না থাকার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দিল। এধরণের চরম অমানুষিকতার পরেও বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ যে পরের দিনই ভুমিকম্পে ধসে মারা যায়নি তার কারণ আল্লাহ নিরন্তর করুণাময়, চরম ধৈর্যশীল।
অনেকে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ কেন পৃথিবীকে এমনভাবে তৈরি করলো না যাতে করে পৃথিবীতে কখনও বন্যা, খরা, মহামারি, ভুমিকম্প না হয়? আল্লাহর তো সব ক্ষমতাই আছে। তিনি কি ইচ্ছা করলেই এমন একটা পৃথিবী তৈরি করতে পারতেন না যেখানে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় না?
সহজ উত্তর – হ্যা, তিনি পারেন এবং তিনি বেহেশত তৈরি করেছেন যেখানে কোন বন্যা, খরা, মহামারি, ভুমিকম্প হয় না। পৃথিবী তৈরির উদ্দেশ্য ছিল না পৃথিবীকে আরেকটা বেহেশত বানানোর।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে পৃথিবীর নিজেকে দূষণ মুক্ত করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার একটি সহজাত প্রক্রিয়া। মানুষ ব্যাপক দূষণ করার পরেও পৃথিবীকে বসবাস যোগ্য রাখার জন্য আল্লাহ তাঁর অসীম জ্ঞান দিয়ে হাজার হাজার স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার মধ্যে একটি।
আল্লাহর বিরুদ্ধে আরেকটি সাধারণ অভিযোগ হল আল্লাহ কেন পৃথিবীতে এত মানুষ পাঠাল, কিন্তু তাদের জন্য যথেষ্ট খাবার, প্রাকৃতিক সম্পদ, জায়গা দিয়ে পাঠাল না। এটি একটি বিরাট ভুল ধারণা যে পৃথিবীতে এত যে গরিব মানুষ তার মূল কারণ পৃথিবীতে সম্পদের বৈষম্য। পৃথিবীত মাত্র ১% মানুষ পুরো পৃথিবীর ৪৮% সম্পদ দখল করে রেখেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১০% মানুষ পুরো পৃথিবীর ৮৫% সম্পদের অধিকারী! মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, যা কিনা প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ, আজকে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১% এর উপর বেঁচে আছে!
শুধু তাই না, মাত্র ২% ধনী মানুষগুলো পুরো পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি বাড়ি এবং জমির মালিক। বাকি অর্ধেক জমি এবং বাড়ির মধ্যে বাকি ৯৮% জনসংখ্যা বসবাস করছে। মানুষের মধ্যে আজকে যে এই চরম বৈষম্য তার কারণ পূঁজিবাদী ভোগবাদী অর্থনীতি, লোভ এবং দুর্নীতি। সুদ হলো আরেকটি বড় কারণ যা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে করে বড় লোকরা বসে বসে আরও বড় লোক হয়, আর মধ্যবিত্ত এবং গরিবরা অমানুষিক খাটার পরেও দিনে দিনে আরও গরিব হতে থাকে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পুরো পৃথিবীর সব মানুষকে, পুরো ৬ বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেকে একটি বাসা এবং সামনে একটি ছোট বাগান দিলেও পৃথিবীর সব মানুষকে যুক্তরাজ্যের এক টেক্সাস অঙ্গরাজ্যেই জায়গা দেওয়া যাবে। আল্লাহ আমাদেরকে এক বিরাট পৃথিবী দিয়েছেন, কিন্তু মাত্র ২% লোভী ভোগবাদী মানুষের কারণে আজকে ১.৬ বিলিয়ন মানুষ দিনে একবেলাও খেতে পারে না।
আল্লাহ কখনই মানব জাতির কোন ক্ষতি করেন না, বরং মানুষরাই মানুষের ক্ষতি করে। (১০:৪৪)
আল্লাহ মানুষকে যথেষ্ট সময় দেন নিজেদেরকে শোধরানোর জন্য। তারপরেও যখন মানুষ শোধরায় না, তখন বিরাট কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, বিপুল পরিমাণের সম্পত্তির ক্ষতি হয় যা ধনীদের কুক্ষিগত থাকে, প্রচুর অসহায় মানুষ মারা যায়, যাদের জীবনটা ইতিমধ্যেই পশুর চেয়েও অধম ছিল। তারপর যে মানুষগুলো বেঁচে থাকে, তারা আবার নতুন করে সভ্যতার শুরু করে। এরকম আগে অনেকবার হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা আছে, হয়তো এই বছরই সেটা হতে পারে।
“মুসলমানরা কেন আজকে সবচেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি?”
এটা নির্ভর করে আপনাকে কে শিখিয়েছে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতির সংজ্ঞা? আমেরিকা? ব্রিটেন? যে দেশে প্রতি ঘন্টায় ৭৮ টা ধর্ষণ হয়, সেই দেশের চেয়ে পশ্চাদপদ দেশ কোনটা আছে পৃথিবীতে? যে দেশে ৬০% দম্পতি তালাক দেয়, তাদের চেয়ে দুর্বল জাতি কোনটা? যে জাতি বছরে ৬.৪ বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট করে এলকোহল জনিত অর্থনৈতিক ক্ষতিতে, ৭.৩ বিলিয়ন পাউন্ড এলকোহল জনিত অপরাধ দমনে, ২.৭ বিলিয়ন পাউন্ড এলকোহল আসক্ত মানুষদের চিকিৎসায়, এবং বছরে ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয় এলকোহল জনিত অসুস্থতা ও অপরাধের কারণে – তাদের চেয়ে দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি কোনটা?
চিন্তা করতে পারেন কত বড় সময় এবং সম্পদের অপচয় এগুলো? এক ব্রিটেনের ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে সাড়া পৃথিবীর ১.৬ বিলিয়ন গরিব মানুষের অভাব দূর করে ফেলা যেত। প্রতি বছর আমরা পৃথিবী থেকে সমস্ত অভাব দূর করে ফেলতে পারতাম এই এলকোহলের কারণে নষ্ট করা সময় এবং সম্পদ দিয়ে। একটা মানুষকেও আর না খেয়ে মারা যেতে হত না। কিন্তু সেটা না করে একদিকে আমরা বিলিয়ন পাউন্ড নষ্ট করছি মদ খাওয়ার ফলে যত ঝামেলা হয় সেগুলো ঠিক করতে গিয়ে, অন্যদিকে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার বাচ্চা মারা যাচ্ছে ময়লা পানি খেয়ে, আঠারো হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে খেতে না পেরে।
আপনি একটা জাতিকে শুধুই তার অর্থনীতি আর প্রযুক্তি দিয়ে বিচার করলে তো হবে না। তাদের নৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দিকগুলো তো দেখতে হবে। একদিকে তারা চাঁদে মানুষ পাঠাচ্ছে অন্যদিকে তারা তেল, সোনা এবং হীরার লোভে আফ্রিকাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন করছে, ঘণ্টায় ৭৮টা ধর্ষণ করছে, ৯৭% ধর্ষণকারীকে একদিনও জেল খাটতে হয়না; যেই দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ Obese এবং তাদের চিকিৎসায় বছরে ১২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়- সেই দেশকে আপনি যদি ‘উন্নত জাতি’ বলেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার বিচার বুদ্ধিতে সমস্যা আছে।
ধরুন আপনি আপনার মেয়েকে আমেরিকাতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন পড়ার জন্য। কয়েক দিন পর সে ক্যাম্পাসে ধর্ষিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফেরত আসলো। আপনি কি তারপরেও বলবেন পশ্চিমা দেশগুলো উন্নত জাতি? আপনি জানেন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রতি চারটা মেয়ের মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার হয়? তাও আবার প্রথম বছরেই? তার মধ্যে ৮৪% মেয়ে কোনদিন কাউকে জানতে দেয় না সেই ঘটনা?
গরীব মুসলিম দেশগুলো সেই তুলনায় কত ভালো আছে, চিন্তা করে দেখুন।
দ্বিতীয়ত, মুসলিম দেশের সংজ্ঞা কি? বাংলাদেশ কি মুসলিম দেশ? আপনি যদি বলেন হ্যা, তাহলে আপনার ইসলামিক রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক ধারনা নেই। বিশ্বের যে দেশগুলোতে ইসলামিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি কার্যকর, যাদেরকে ‘ইসলামিক দেশ’ বলা যেতে পারে, সেগুলো হল সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরান, লিবিয়া ইত্যাদি। সেগুলোর একটাও দুর্বল, পশ্চাদপদ, নিপীড়িত জাতি নয়।
“কেন ধর্মের নামে সবচেয়ে বেশি খুনাখুনি, যুদ্ধ? আল্লাহ থাকলে তা হয় কিভাবে?”
বিংশ শতাব্দীর আগে যত হত্যা হয়েছে, তার মধ্যে ৩% হত্যা ধর্মীয় ঘটনার সাথে জড়িত। বাকি ৯৭% হত্যা যুদ্ধ, রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসী কারণে।
সুত্রঃ STATISTICS OF DEMOCIDE
নাস্তিকরা এই বিংশ শতাব্দীতে ১৫
কোটির বেশি মানুষ
খুন করেছে। পুরো
বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমান মানুষ তারা
এই বিংশ
শতাব্দীতেই মেরে শেষ করেছে।
সুত্রঃ The
Irrational Atheist
১৯১৭ থেকে
২০০৭ পর্যন্ত
মোট ১৪.৮ কোটি
মানুষ মারা
গেছে ৫২ জন
নাস্তিকের কারণে, যা পুরো বিংশ
শতাব্দীতে যুদ্ধ, গৃহ যুদ্ধ এবং
সকল অন্যয়ের
কারণে মারা
যাওয়া মোট জনসংখ্যার চেয়ে ৩ গুণ
বেশি! নোবেল
পুরস্কার জয়ী
Aleksandr Solzhenitsyn পঞ্চাশ বছর
ধরে গবেষণা
করে বের
করেছেন যে
রাশিয়াতে যে
৬ কোটি
মানুষ মারা
গেছে কমিউনিজমের
কারণে, তার
আসল কারণ
নাস্তিকতা।সুতরাং ধর্মীয় কারণে যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়, সবচেয়ে বেশি খুনাখুনি হয়, সবচেয়ে বড় যুদ্ধগুলো হয় – এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আপনি মিডিয়ার মগজ ধোলাইয়ের শিকার, আর কিছু না। টিভিতে যা দেখেন এবং পত্রিকায় যা পড়েন, সেটাই বিশ্বাস না করে যথাযথ সরকারী পরিসংখ্যানগুলো পড়ে দেখুন। যেহেতু মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নাস্তিকদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, তাই তারা কৌশলে এইসব তথ্য ধামাচাপা দিয়ে রাখে এবং ধর্মের নামে কিছু ঘটলে সেটাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে।
“শুধু মুসলমানরাই এতো সন্ত্রাসী, টেররিস্ট হয় কেন?”
১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে অ্যামেরিকাতে মাত্র ৬% আক্রমণ হয়েছে মুসলমান চরমপন্থিদের দ্বারা, বাকি ৯৪% আক্রমণ হয়েছে ল্যাটীনো, বামপন্থি চরম পন্থি, ইহুদি চরমপন্থি, কম্যুনিস্ট, বর্ণবাদ এবং অন্যান্য সংগঠন দিয়ে।
একই ভাবে ইউরোপে ৯৯.৬% আক্রমনের পেছনে কোন মুসলিম দলের হাত নেই।
সুতরাং যারা বলে মুসলমানরাই খালি টেররিস্ট হয়, তারাই শুধু মারামারি, খুনা খুনি করে, কাশ্মীরের উদাহরণ দেয় – তারা আসলে মিডিয়ার মগজ ধোলাইয়ের শিকার, আর কিছু না। টিভিতে যা দেখেন এবং পত্রিকায় যা পড়েন সেটাই বিশ্বাস না করে যথাযথ সরকারী পরিসংখ্যানগুলো পড়ে দেখুন। যেহেতু ইসলাম প্রচার হলে এবং ইসলামিক আইন ব্যবস্থা আসলে পৃথিবীর বেশিরভাগ ধনী এবং খমতাবান মানুষকে তাদের বিশাল সম্পত্তি, অন্যায় ব্যবসা, মদ, জুয়া, নারী সঙ্গ সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে, সেহেতু তারা আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে হাত করে রেখে যেভাবে সম্ভব ইসলামের নামে অপপ্রচার করে ইসলামকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য।
“আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন? এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো অন্যায়”
হিটলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ মেরে গেছে। তাকে যদি ছয় লাখ বার আগুনে ঝলসানো হয় তাহলে কি তাকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে? যতদিন পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত হিটলারের এই গণহত্যার কারণে যেই ক্ষতিটা হয়ে গেছে, তাকে তার জন্য ছয় লাখ বার আগুনে ঝলসালেও কিছুই হবে না। তাকে ছয় কোটি বার ফুটন্ত পানিতে চুবালেও সেই ছয় লক্ষ মানুষের পরিবারের কষ্টের সমান কষ্ট দেওয়া হবে না। সেই ছয় লক্ষ মানুষ যে কয়েক কোটি মানুষকে জন্ম দিতে পারতো, তার উসুল হবে না।
“আমরা তো হিটলার না। আমরা তো মানুষ খুন করছি না, বা তেলের লোভে যুদ্ধ করছিনা, অথবা গরীব মানুষের টাকা মেরে দিচ্ছিনা। আমাদেরকে কেন আল্লাহ ফুটন্ত পানিতে ঝলসাবে, আগুনে চামড়া পুড়িয়ে আবার নতুন চামড়া দিবে বার বার কষ্ট দেবার জন্য? আমরা এমন কি দোষ করলাম যার জন্য এত ভয়াবহ শাস্তি পাবো?”
আমাদের প্রতিটা দোষের ফলাফল এবং প্রভাব যে কত ব্যাপক, সেটা আমরা কখনও ঠিকভাবে চিন্তা করে দেখিনা। আমরা অনেকেই মনে করি – আমরা যেসব পাপ করি সেগুলো ছোটখাট ব্যপার। এর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে এত বড় শাস্তি দিবেন না। কয়েকটা দিন হয়তো দোযখে একটু কষ্ট করবো, ব্যাস, তারপরেই মুক্তি। এধরণের মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেনঃ
তারা বলে, “আগুন আমাদের মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে”। তাদেরকে বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার নিয়েছ – কারণ আল্লাহ কখনো অঙ্গীকার ভাঙেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে এমন কিছু বল যা নিয়ে তোমাদের কোনই জ্ঞান নেই?” (২:৮০)
কিছু উদাহরণ দেই।
উদাহরণ – ১
আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে বসে একদিন একটা অশ্লীল হিন্দি গান দেখলেন। আপনার কাছে ব্যাপারটা কিছুই না, কারণ আপনার বয়স চল্লিস, আপানার চোখ এসব দেখতে দেখতে ইতিমধ্যে গা সওয়া হয়ে গেছে। আপনার কাছে এগুলো আর গায়ে লাগে না। কিন্তু আপনার ১১ বছরের যৌন আকাঙ্ক্ষায় টগবগে কিশোরের গানের একটা শট দেখে মাথা ঘুরে গেল। সে দিনে রাতে যখনি চোখ বন্ধ করে তখনি সেই শটটা বার বার দেখতে পায়। তারপর থেকে তার বাথরুমে গোসল করতে আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগা শুরু হল, সে তার ঘরের দরজা লক করে থাকা শুরু করলো, বন্ধুর বাসায় গিয়ে রাতে দেরি করে ফেরা শুরু হল, নানা কারণে দিনে রাতে যখন তখন বাসার বাইরে যাওয়া আসা আরম্ভ হল। এখান থেকে শুরু হল তার পতন। একসময় সে বিয়ে করলো এবং তার দীর্ঘ দিনের বদভ্যাসের ফলে শারীরিক সমস্যার কারণে বিকলাঙ্গ, না হয় অসুস্থ সন্তানের জন্ম দিল। তার পরিবারে চরম অশান্তি নেমে আসলো। সারাটা জীবন তাকে চরম কষ্ট করে, তার পোড়া কপালের জন্য আল্লাহকে দোষ দিয়ে, এক দুর্বিষহ জীবন পার করতে হল।
আপনি এটা পুরোটাই প্রতিরোধ করতে পারতেন অশ্লীল হিন্দি গানটা শুরু হবার সাথে সাথে চ্যানেল পালটিয়ে দিয়ে এবং জোরে জোরে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে যে অশ্লীল হিন্দি গান দেখাটা একটা খুবই খারাপ জিনিস। আপনার ছেলে আপনার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝত, এটা খুবই খারাপ কাজ এবং তারপর সে তার বাকি জীবনটা সংযত রাখত। সে আগামী বিশ বছর প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে বাথরুমে সময় নষ্ট না করে বিশ বছরে প্রায় ৩,৬৫০ ঘণ্টা কোন ভালো কাজ করে ব্যাপক পুণ্য অর্জন করতে পারত।
একটি ছেলের জীবন নষ্ট করে, সে যত ভালো কাজ করতে পারত এবং সেই ভালো কাজগুলোর জন্য যত মানুষের যত উপকার হত সেটা না হতে পারার জন্য; তার স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ির সারাজীবন দুখের জন্য এবং একটি বিকলাঙ্গ বা অসুস্থ প্রজন্মের শুরু করার জন্য আপনাকে যদি আল্লাহ কয়েক হাজার বার চামড়া আগুনে পুড়িয়ে আবার নতুন চামড়া দেন, আপনি কি বলবেন শাস্তিটা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছে? আপনি কি তখন চিল্লাচিল্লি করবেন – “আমিতো একটা হিন্দি গানই দেখেছিলাম!”
(জাহান্নামে তাদেরকে বলা হবে) “তোমাদেরকে কি আমার বাণী বার বার শোনানো হয় নি? তারপরেও কি তোমরা অমান্য করনি?” তারা বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা/অবাধ্যতায় ডুবে ছিলাম, আমরা একটা বিভ্রান্ত জাতি ছিলাম। ও আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। আমরা যদি এরপরেও একই কাজ করি, তাহলে আমরা সত্যিই অন্যায়কারী।” (২৩:১০৫-১০৭)
উদাহরণ – ২
একদিন সকালে আপনি আপনার ড্রাইভারকে অসন্তোষ্ট,রাগ ওঅধর্য হয়ে একটা চড় মেরে তেল আনতে পাঠালেন। ড্রাইভার রাগে গজ গজ করতে করতে উল্টাপাল্টা গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় আরও দশ জন মানুষের মেজাজ খারাপ করে পেট্রোল পাম্পে গেল। সেই দশ জন মানুষ তাদের মেজাজ খারাপটা ছাড়ল রাস্তার আরও বিশ জন মানুষের উপর। সেই ত্রিশ জন লোক বাসায় ফিরে ত্রিশটা পরিবারের একশ জন সদস্যর উপর মেজাজ ছাড়ল। সেই একশ পরিবারের সদস্য তাদের মনের ঝাল মেটাল তাদের হাজার খানেক বন্ধু, আত্মীয়ের উপর।
আপনি সেদিন ড্রাইভারকে চড় মেরে একটা চেইন রিয়েকশন শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই চেইন রিয়েকশনের ভুক্তভুগি হাজার হাজার মানুষের কষ্টের জন্য আপনি দায়ী। আপনাকে যদি একটা চড় মারার জন্য জাহান্নামে এক লক্ষ বার লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, আপনি কি বলবেন, “আমিতো কোন বড় দোষ করিনি,ড্রাইভারকে সামান্য চড় মেরেছি মাত্র ,দোযখের শাস্তি এতো কঠিন কেন?”
তুমি যদি দেখতে পেতে, যখন অপরাধীরা মাথা নত করে বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা দেখলাম এবং শুনলাম। আমাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিন। এবার আমরা ভালো কাজ করবো। আমরা এবার নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি। ” (৩২:১২)
উদাহরণ – ৩
ধরুন আপনার স্বামী (বা স্ত্রীর) সাথে তুমুল ঝগড়া হল। যার ফলে আপনি মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে গেলেন এবং শয়তান এই সুযোগ নিয়ে আপনাকে টিভিতে হিন্দি গান দেখার, ফেইসবুকে ফ্লার্ট করার অথবা মোবাইলে পরকীয়া করার সুযোগ করে দিল। যেহেতু ঝগড়া করে আপনি এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল, আপনি নোংরামি থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না, বরং এক ধরণের প্রতিশোধ নেবার মনোভাব থেকে – “আমার সাথে ঝগড়া করেছ? দাঁড়াও, আমি এখন বেশি করে পর্ণ দেখে, ফেইসবুকে আমার বয়ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ফ্লার্ট করে তোমাকে মজা দেখাচ্ছি” – এই মনে করে আপনি পাপে ডুবে গেলেন।
এখন আপনি দাবি করবেন, “ঝগড়া করে মেজাজ খারাপ ছিল, এজন্য এসব করেছি। এটা কোন মহা পাপ না, একটা মামুলি ঘটনা।”
এই মামুলি ঘটনা থেকে যদি আপনার অন্যায়ের তালিকা তৈরি করি, তাহলে কমপক্ষে এই কয়েকটা কারণে আপনাকে আল্লাহর আদালতে অভিযুক্ত করা যাবেঃ
- পরিবারের সদস্যের সাথে অসাদাচারন।
- পরিবারের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি।
- পরিবারের সদস্যের সাথে বেইমানি করা।
- শয়তানের সাথে সহযোগিতা করা।
- নিজের ঈমান দুর্বল করা।
- ঈমান দুর্বল হবার কারণে ভবিষ্যতে করা সকল পাপ কাজ।
- অন্যের অন্যায় সমর্থন করা।
- অন্যের কাছে অন্যায় প্রচার করা।
- অশ্লীলতা গ্রহন এবং প্রচার করা, অশ্লীল সাইটের ট্রাফিক বৃদ্ধি করে তাদের উপার্জন বৃদ্ধি করা।
- অশ্লীল কাজে একাধিক মানুষের সময়ের অপচয়।
- অশ্লীল কাজে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়।
- অশ্লীল কাজে পারিবারিক সম্পদের অপচয়, যা আপনার পরিবারের সদস্যদের হক।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা চিন্তা করিনা আমাদের প্রতিটি কথা এবং কাজের ফলাফল কত ব্যাপক। আমরা মনে করি আমরা যখন একজনকে কিছু বলি, বা একজনের সাথে কিছু করি, তার প্রভাব শুধুই তার উপর এবং তার কাছের মানুষের উপর পড়বে। কিন্তু তা নয়। আমাদের প্রতিটা কথা এবং কাজ সমাজে একটা চেইন রিয়েকশন শুরু করে দেয়। এমনকি ইন্টারনেটের বদলে আজকাল তার প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকটা খারাপ কথা বা কাজের জন্য আমাদেরকে দুই এক বার শাস্তি দিলে সেটা নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার হবে না? বরং আমাদের কোন খারাপ কথা বা কাজের জন্য পৃথিবীতে যত মানুষের যত ক্ষতি হবে, তার সমান শাস্তি আমাদেরকে দিতে হবেই, যদি সত্যিই ন্যায়বিচার করতে হয়।
সালাম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :উইকিপিডিয়া,ইসলামিক রিসোর্স সেন্টার ব্লগ ও ইন্টানেট হতে সম্পাদিত ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন