বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৫

বাংলাদেশে সর্বনাশা ইয়াবার নেশার জগত !অব্যাহত ভাবে চলছে রাতারাতি ধনী হবার ব্যবসা !!

বাংলাদেশে সর্বনাশা ইয়াবার নেশার জগত
অব্যাহত ভাবে চলছে রাতারাতি ধনী হবার ব্যবসা !

দশ পনের বছর আগে ইয়াবা শব্দটির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ছিল নাএখন সবার কাছে নামটি পরিচিত। নেশার জগতে খুব দ্রুত প্রভাব বিস্তারকারী এ বস্তুটি এখন নগর ছেড়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছেপ্রায় প্রতিদিন ধরা পড়ছে হাজার থেকে লক্ষাধিক পিস ইয়াবাআর রাতারাতি টাকার কুমির বনে যেতে মরণ নেশার এই অবৈধ ব্যবসায় নেমে পড়েছেন এমপি থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যও

কী এই ইয়াবা?
থাইল্যান্ডে ইয়ারার ব্যবহার ও উৎপাদন বেশি বলে এর নাম থাই ভাষায় রাখা হয়েছে ইয়াবাথাই ভাষায় ইয়াবা নামটির অর্থ হলো ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ
ইয়াবার উপাদান :
ইয়াবার মূল উপাদান মেথাম্ফেটামিনসঙ্গে থাকে উত্তেজক পদার্থ ক্যাফেইন২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম মেথাম্ফেটামিনের সঙ্গে ৪৫ থেকে ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন মিশিয়ে তৈরি এ ট্যাবলেটের রং সাধারণত সবুজ বা লালচে কমলা হয়ে থাকেএর নানা রকম ফ্লেভার আছেআঙ্গুর, কমলা বা ভ্যানিলার স্বাদে একে অনেকে ক্যান্ডি বলে ভুল করবেএ কারণে এগুলো সহজে পরিবহন ও লুকিয়ে রাখা যায়এর আকৃতি ড্রিঙ্কিং স্ট্রর ছিদ্রের সমান স্বাদ-গন্ধ থাকার ফলে বিক্রেতারা সহজেই তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং তারা একে ক্ষতিকারক মনে করে নালজেন্স ভেবে অনেকে এটাকে সহজেই খেয়ে নেয়
দেশে দেশে ইয়াবা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, ব্রিটেন, জার্মানি ও আমেরিকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা জেগে থাকতে এবং ক্লান্তি দূর করতে এটা খেতযুদ্ধের পর এ ওষুধের বিশাল মিলিটারি স্টক ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের হাতে১৯১৯ সালে জাপানে সর্দি আর নাক বন্ধের ওষুধ হিসেবে এটি ব্যবহার করা হতোমেদভুড়ি কমানোর জন্যও এ জিনিস ব্যবহার করা হয়েছেএকসময় থাইল্যান্ডে এ ড্রাগ পেট্রলপাম্পে বিক্রি হতো১৯৭০ সালে এ ওষুধের মূল উপাদান থাইল্যান্ড এবং সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হলেও থাইল্যান্ডের ট্রাকচালকদের মধ্যে এর বহুল ব্যবহার ছিলকারণ ইয়াবা খেলে ঘুম আসে না, রাতভর ট্রাক চালানো যায়কিছু ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সবাই টের পেল যে রাতভর ট্রাক চলে বটে, তবে তা পথে নয়, চলে খানাখন্দ আর ব্রিজ ভেঙে নদীতেট্রাক চালক সেটি টের না পেলেও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তার পরিবার ঠিকই  টের পায় ইয়াবা কী জিনিস
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
প্রথমদিকে ইয়াবা যৌন উত্তেজক বড়ি হিসাবে বাজারে পরিচিত ছিলোকিন্তু দীর্ঘদিন সেবনের ফলে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারেযুক্তরাজ্যের ড্রাগ ইনফরমেশন এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ইয়াবা ট্যাবলেটটি খেলে সাময়িক ভাবে উদ্দীপনা বেড়ে যায়কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক-ক্ষমতা আছে এবং তা অনেকক্ষণ থাকে বলে কোকেনের চেয়ে অ্যাডিক্টরা এটা বেশি পছন্দ করেইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা, অনিদ্রা, খিটখিটে ভাব ও আগ্রাসী প্রবণতা বা মারামারি করার ইচ্ছা, ক্ষুধা কমে যাওয়া ও বমি ভাব, ঘাম, কান-মুখ লাল হয়ে যাওয়া এবং শারীরিক সঙ্গের ইচ্ছা বেড়ে যায়তবে এ সবই অল্প কয়েক দিনের বিষয়
ইয়াবা খেলে বাড়ে হৃৎস্পন্দনের গতি, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শরীরের তাপমাত্রামস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোর ক্ষতি হতে থাকে এবং রক্তের প্রচণ্ড চাপে কারও কারও এগুলো ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়কিছুদিন পর থেকে ইয়াবাসেবীর হাত-পা কাঁপে, হ্যালুসিনেশন হয়, পাগলামি ভাব দেখা দেয়, প্যারানয়া হয় হ্যালুসিনেশন হলে রোগী উল্টোপাল্টা দেখে, গায়েবি আওয়াজ শোনেআর প্যারানয়াতে ভুগলে রোগী ভাবে, অনেকেই তার সঙ্গে শত্রুতা করছেতারা অনেক সময় মারামারি ও সন্ত্রাস করতে পছন্দ করে

কারও কারও শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, খিঁচুনি হয়খিটখিটে ভাব, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুর, নার্ভাসনেসে ভুগতে থাকে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিরাস্মরনশক্তি কমে যায়, সিদ্ধান্তহীনতা এবং কারও কারও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়অনেকে আবার উন্মাদও হয়ে যায় কেউ কেউ হতাশায় ভুগতে শুরু করে এবং এ থেকে আত্মহত্যার পথও বেঁছে নেয় অনেকে হার্টের ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের রক্তনালি ছিঁড়ে অনেকে মারা যায়কেউ আবার রাস্তায় চলন্ত গাড়িকে তোয়াক্কা না করে দুর্ঘটনায় অকালে জীবন হারায়কেউ কেউ টানা সাত থেকে ১০ দিন জেগে থাকে, তারপর ড্রাগ ওভার ডোজেও মারা যায়
বাংলাদেশে ইয়াবা:
বাংলাদেশে ইয়াবার মূল চালান আসে পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে চোরাই পথেবাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে ১৯৯৭ সালেপরবর্তীতে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করেমিয়ানমারে ওয়া এবং কোকাং নামের আদিবাসী সম্প্রদায় মেথাম্ফেটামিন পিল বা ইয়াবা এর সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারীএই দুই গোষ্ঠীর লোকজন পূর্বে আফিম এবং হেরোইন উৎপাদন এর সাথে জড়িত ছিলউল্লেখ্য যে, মিয়ানমারে খুব সাধারণ ল্যাবরেটরিতেও মাত্র ২০ হংকং সেন্টের বিনিময়ে প্রতিটি ইয়াবা পিল তৈরি করা হতো২০০০ সালে থাইল্যান্ডের সরকার মিয়ানমার সরকারকে সীমান্তে যৌথ টহলের জন্য ব্যাপক চাপ দেয়থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারের মধ্যে বিদ্যমান ২৪০০ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার ব্যাপক চোরাচালান রোধের জন্য এই চাপ প্রয়োগ করা হয়এই ট্যাবলেটের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি হবার কারণে উচ্চবিত্তদের মাঝেই এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে
ঢাকায় তিন ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায় প্রথম ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেটের বেশির ভাগ সবুজ বা গোলাপি রঙের হয়এর ঘ্রাণ অনেকটা বিস্কুটের মত হয়ে থাকেদ্বিতীয় ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেট এর দাম তুলনামূলক কমকিন্তু এটিও নেশা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেতৃতীয় ধরনের ট্যাবলেটি আরও সস্তা এবং নেশায় আসক্তদের নিকট এটি ভেজাল বলে পরিচিত ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা অনুসারে চিতা নামের পিলটি সবচেয়ে নিম্নমানের ইয়াবা পিল হিসেবে গণ্য হয়এর গায়ে ক্ষুদ্র চিহ্ন থাকে অন্যদিকে গোলাপ জল নামের ইয়াবা পিলকে উচ্চ মান পিল হিসেবে গণ্য করা হয় ইয়াবা পিলের গায়ে ইংরেজি ডাব্লিউ ওয়াই (WY) লেখা থাকেওয়াই (Y) লেখার ধরণ দীর্ঘ হলে এবং ইয়াবার রঙ পুরোপুরি গোলাপি হলে ধারণা করা হয় সেটি  ইয়াবা হিসেবে ভাল মানের

ইয়াবার কুফল :
ইয়াবা একটি ভয়ানক অভিশাপ হিসেবে জাতির উপর ছওয়ার হয়েছেএই জীবন ঘাতি ইয়াবার ছোঁবল থেকে জাতিকে বাচাবে কে? এই প্রশ্ন এখন সর্বত্রইকারণ বৃদ্ধ-বণিতা, ছাত্র-শিক্ষক, যুবক-চিকিৎসক, সরকারী-বেসরকারী চাকুরীজীবি, বিভিন্ন শ্রেণীর পেশাজীবি মানুষ কেউ রেহাই নেই এই মরণ নেশা ইয়াবা নামক মাদকের ভয়াবহতা থেকে
সামাজিক শৃঙ্খলাকে ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত করে জাতিকে পঙ্গু ও আগামী প্রজন্মকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে চারিত্রিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করছে এই ইয়াবাএই সর্বনাশা ইয়াবার রঙ্গিন নেশায় মত্ত হয়ে সেবনকারীরা স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্বীয়-স্বজনকে মূল্যায়ন তো দুরের কথা তাদের মনোবাসনা (ইয়াবার সেবনের টাকা) পূরনে র্ব্যথ হলে আক্রান্ত করতে দি¦ধাবোধ করেনাতাদের মনোভাব এতই ভয়ানক হয় যে, তার জলন্ত উদাহারণ ঢাকায় পুলিশ অফিসার দম্পতির একমাত্র আদরের মেয়ে ঐশিইয়াবা সেবন করে নৃশংস ভাবে খুন করে পিতা-মাতাকেএ ভাবে সমাজে প্রতিদিন ইয়াবা সেবন কারিদের হাতে কোথাও না কোথাও অপ্রিতিকর ঘটনা ঘটছে
সর্বগ্রাসী এই ইয়াবা নামক মরণ নেশার ছোবল থেকে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কালক্ষেপন না করে সমাজের সুষ্ঠু মস্তিস্ক সম্পন্নদের নিয়ে বিহীত ব্যবস্থা নেয়া সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাড়িঁয়েছেতা না হলে একদিন এ জাতি অথৈ গহ্বরে তলিয়ে যাবেএতে কোন সন্দেহ নেই

কোন মন্তব্য নেই: