সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫

সুনামগঞ্জ জেলার অজানা ইতিহাস

প্রাচীন ইতিহাস:সুনামগঞ্জের ইতিহাস অতি প্রাচীন। অসংখ্য কিংবদন্তী এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। প্রাচীন ইতিহাস থেকে অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল এককালে আসামের কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সুনামগঞ্জের লাউড় পরগনায় এখনো প্রবাদ হিসেবে কথিত আছে লাউড় পাহাড়ের উপরই কামরূপের রাজা ‘ভগদত্তের’ রাজধানী ছিল। এ ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন বলেও কিংবদন্তী রয়েছে। টাংগাইলের মধুপুর বনেও উক্ত রাজারবাড়ীর চিহ্ন ছিল বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ ভগদত্ত ও মহাভারতের ভগদত্ত এক ব্যক্তি নন, বরং কথিত ভগদত্ত মহাভারতের অনেক পরের কালের মানুষ। এটাই সত্য। কারণ কিংবদন্তী ও ইতিহাস যেখানে মিল হবে না সেখানে ইতিহাস ভিত্তি ধরাই বিধেয়।
বৃহত্তর সিলেট সুদূর অতীতে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ রাজ্যগুলো হচ্ছে লাউড় গৌড় ও জয়ন্তিয়া। অনুমান করা হয়, এ লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল লাউড়। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়া নামে পরিচিতি গ্রামে লাউড়ের রাজা বিজয় সিংহের বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। স্থানীয়ভাবে এটি হাবেলী (হাওলী) নামে পরিচিতি।
লাউড় রাজ্যের নৌঘাটি ছিল দিনারপুর নামক স্থানে। এটি বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। রাজধানী লাউড় থেকে নৌঘাটি পর্যন্ত সারা বছর চলাচল উপযোগী একটি ট্রাংক রোডের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের সমর্থন পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জের তদানীন্তন ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুলস জনাব মুহাম্মদ ওয়াসিল উক্ত ট্রাংক রোডের ধ্বংসাবশেষ থেকে এ তথ্য উদঘাটন করেছিলেন। মনে করা হয় লাউড় অধিপতি কর্তৃক এ ট্রাংক রোডটি নৌঘাটিতে সংযোগ স্থাপনের জন্যই নির্মিত হয়েছিল।
অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার বেশীর ভাগ অঞ্চল এককালে একটি সাগরের বুকে নিমজ্জিত ছিল যা কালে কালে পলি ভরাট জনিত কারণে ও ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সূত্র ধরে ভূখন্ডে পরিণত হয়েছে। সুনামগঞ্জের ভূগর্ভে চুনা পাথরের খনি ও কয়লা আবিস্কারের ফলে এরূপ চিন্তার সক্রিয় সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া এখানকার শত শত হাওরের গঠন প্রকৃতি (basin type) বিশ্লেষণ করেও এ মতের সমর্থন দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট প্রাপ্ত চুনাপাথর এক ধরণের ক্যালসিয়াম যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবাল দ্বারা সৃষ্ট। এতেও পূর্বোক্ত ধারণার পেছনে বৈজ্ঞানিক যোগ সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়
প্রায় সব ঐতিহাসিক সূত্র মতে, সুনামগঞ্জের বিশাল ভূখন্ড যে সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে সে সাগরকে ‘কালিদহ’ সাগর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কালিদহ সাগর সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। হাছন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা চৌধুরীর আত্মজীবনী মূলক রোজনামচাতেও এর উল্লেখ রয়েছে; রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক গান, পালা-পার্বণের অনুষ্ঠানগুলিতেও।
খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা চৌধুরী
সিলেটের কালেক্টর মিঃ লিন্ডসের অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত বর্ণনা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- “In the pre Historic days the southern part of Sadar Subdivision and the northern part of Moulivibazar and Habiganj Subdivision and nearly the entire Sunamganj Subdivision were a part of Bay of Bengal.”
হাওর শব্দটি সায়র (সাগর) থেকে এসেছে। বর্ষাকালে সুনামগঞ্জের হাওরগুলো এখনো সে রূপই ধারণ করে। সুদূর অতীতে এই কালিদহ সাগর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার উপর দিয়ে ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং জাহাজে করে সরাসরি তাম্রলিপ্ত থেকে সিলেট পৌঁছেছিলেন বলে তাঁর লেখা থেকে জানা যায়।
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং

(৬০২-৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দ)
তাঁর মতে, নহরী আজরক নামে একটি নদী কামরূপের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে হাবাং শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদী দিয়ে বাংলা ও গৌড়ে যাওয়া যেত। এ নদীকে প্রাচীন সুরমা বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।

ইতিহাসের গতিধারায় সুনামগঞ্জ
১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ মবারক দৌলা মালিক লাউরের উজির হন
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দ খাসিয়া কর্তৃক বর্তমান ধর্মপাশা উপজেলার অধীনস্থ সেলবরষ, বংশীকুন্ডা ও রামধীঘা পরগনা আক্রমণ ও ৩০০ লোক হত্যা
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ ছাতকে ইংলিশ কোম্পানী স্থাপন
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ দশসনা বন্দোবস্ত
১৭৮৮-৯০ খ্রিস্টাব্দ হস্তবোধ জরিপ
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ মরমী কবি রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থের জন্ম
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ মরমী কবি হাছন রাজার জন্ম
১৮৬০-৬৬ খ্রিস্টাব্দ থাকবাস্ত জরিপ
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দ বৃহত্তর সিলেট জেলাকে আসামের অন্তর্ভূক্তকরণ
১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ সুনামগঞ্জ মহকুমা স্থাপন
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ সুনামগঞ্জ সদর থানা স্থাপন
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ ভয়াবহ ভূমিকম্প
১৯০২ খ্রিস্টাব্দ গৌরিপুর জমিদার কর্তৃক ছাতকের ইংলিশ কোম্পানী ক্রয়
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ বঙ্গভঙ্গ
১৯১১ খ্রিস্টাব্দ বঙ্গভঙ্গ রোধ
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ মরমী কবি রাধারমণ দত্তের মৃত্যু ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ ১৫ ফেব্রুয়ারি বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের জন্ম
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ শাল্লা থানা স্থাপন ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার প্রতিষ্ঠা

১৯২১ খ্রিস্টাব্দ মরমী সাধক দুর্বিন শাহ্ জন্মগ্রহণ
১৯২২ খ্রিস্টাব্দ মরমী কবি হাছন রাজার মৃত্যু, ছাতক ও জগন্নাথপুর থানা স্থাপন
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ সিলেট প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়ন
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ জামালগঞ্জ থানা স্থাপন ও ছাতক সিমেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠা
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ দিরাই, তাহিরপুর ও ধর্মপাশা থানা স্থাপন
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ সুনামগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠা
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ সাধারণ নির্বাচন
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ গণভোট ও দেশ বিভাগ
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পূর্ববাংলা প্রজাস্বত্ব আইন ও জমিদারী প্রথা বিলোপ]
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও ছাতকে রেল লাইন প্রতিষ্ঠা
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ মহকুমা আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠা
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ স্বাধীনতা লাভ
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুর থানা স্থাপন
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ সুনামগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দ সুনামগঞ্জ মহকুমা জেলায় উন্নীত
১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ সিলেট বিভাগ এর কার্যক্রম শুরু
২০০৭ খ্রিস্টাব্দ দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানা স্থাপন

 ভৌগলিক পরিচিতি:
সুনামগঞ্জ জেলা

২৪০৩৪ থেকে ২৫০১২৯০০উত্তর অক্ষাংশ  ৫৬ থেকে ৯১০৪৯পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। 
বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের কোল ঘেষে সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থান। এ জেলার উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলা, পূর্বে সিলেট জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলা।
নামকরণ:
‘সুনামদি’ নামক জনৈক মোগল সিপাহীর নামানুসারে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়।‘সুনামদি’ (সুনাম উদ্দিনের আঞ্চলিক রূপ) নামক উক্ত মোগল সৈন্যের কোন এক যুদ্ধে বীরোচিত কৃতিত্বের জন্য সম্রাট কর্তৃক সুনামদিকে এখানে কিছু ভূমি পুরস্কার হিসাবে দান করা হয়।
মোগল সিপাহী
তাঁর দানস্বরূপ প্রাপ্ত ভূমিতে তাঁরই নামে সুনামগঞ্জ বাজারটি স্থাপিত হয়েছিল।এভাবে সুনামগঞ্জ নামের ও স্থানের উৎপত্তি হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে।
এক নজরে সুনামগঞ্জ জেলা :
বিষয়
বৈশিষ্ট্য
আয়তন
৩৭৪৭.১৮ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা
২৪,৬৭,৯৬৮ জন (আদমশুমারী ২০১১)
পুরুষ 
১২,৩৬,১০৬ জন
মহিলা
১২,৩১,৮৬২ জন
জন সংখ্যার ঘনত্ব
৬৫৯ জন (প্রতি বর্গ কি:মি:)
পুরুষ-মহিলা অনুপাত
১০১:১০০
নির্বাচনী এলাকা
০৫ টি
মোট ভোটার সংখ্যা
১৫,০২,৯৭৩ জন
পুরুষ ভোটার
,৫১,২৬০ জন
মহিলা ভোটার
,৫১,৭১৩ জন
উপজেলা
১১টি
থানা
১২টি
পৌরসভা
৪টি
ইউনিয়ন
৮৭টি
মৌজা   
১৫৩৫টি
গ্রাম
,৮৮৭টি
নগরায়ন
১০.৩৮%
বার্ষিক বৃষ্টিপাত
৩৩৩৪ মি.মি.
বার্ষিক গড় তাপমাত্রা
সর্বোচ্চ ৩৩. সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ১৩. সেলসিয়াস
আর্দ্রতা
৭৮%-৯০%
সরকারি হাসপাতাল
১২টি
 স্বাস্থ্য কেন্দ্র
২২টি
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
.০২
শিশু মৃত্যুর হার
৬২ ( প্রতি হাজারে)
গড় আয়ূ
৬২ বছর
মহাবিদ্যালয়
২৬টি, সরকারি-২টি, বেসরকারি-২৪টি
মাধ্যমিক বিদ্যালয়
২০৯টি, সরকারি-৫টি, বেসরকারি-২০৪ টি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
৮৫৬টি
কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়
০৪টি
মাদ্রাসা (সকল)
৯৭টি
স্বাক্ষরতার হার 
৩৫%, পুরুষ-৩৬.০৯%, মহিলা-৩৩.০১ %
সুনামগঞ্জ জেলার প্রথম মহকুমা প্রশাসক
মি. ব্ল্যাক
বর্তমান জেলা প্রশাসক 
শেখ রফিকুল ইসলাম
ডাকঘর
১১১টি
বিদ্যুতায়িত গ্রাম
৩৪%
টেলিফোন গ্রাহক
,৫১০ জন
টিউব ওয়েল
সরকারি-২০,৫১৭টি, বেসরকারি-২১,৯৯২টি
নদী
২৬টি
বদ্ধ জলমহাল (২০ একরের ঊর্ধ্বে)
৪২০টি
বদ্ধ জলমহাল (২০ একরের নিচে)
৬২৫টি
উন্মুক্ত জলমহাল
৭৩টি
হাট-বাজার
২১৬টি
মোট জমি
,৭৯,২১৬ হেক্টর
মোট আবাদী জমি
,৭৬,৪৩৪ হেক্টর
কৃষি পরিবার
,৯৪,১০৯টি
পেশা (কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল )
৪৩.৮৬%
সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক দূরত্ব      
৬৮ কি:মি:
সুনামগঞ্জ- ছাতক সড়ক দূরত্ব 
৫৭ কি.মি.
সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর  সড়ক দূরত্ব       
৪৪ কি.মি.
সুনামগঞ্জ-দিরাই সড়ক দূরত্ব  
৩৭ কি.মি.
এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়িত গ্রোথ সেন্টার
৪৪টি
বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা
৯০টি
নিবন্ধিত সমবায় সমিতি
প্রাথমিক-,৫৫২টি, কেন্দ্রীয়-০৮টি
বিসিক শিল্প নগরী
জমির পরিমাণ-১৬.১৫ একর, মোট প্লট - ১১৬টি
নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
৮৭৯ টি
এতিমখানা
সরকারি-১টি, বেসরকারি-১১টি
ঘূর্ণায়মান তহবিল
৭১,০৮,৯৪৩/-
শিল্প কারখানা
০৫টি () ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি () টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প () লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি () ছাতক পাল্প এন্ড পেপার মিলস () আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ লি:
মসজিদ
৩০৮৩টি
মন্দির
৪৩০ টি
গীর্জা
০৯টি
ইউনিয়ন ভূমি অফিস
২৯ টি এবং ক্যাম্প অফিস-০৫টি
পাকা রাস্তা
,৮৮৫ কি.মি.
কাঁচা রাস্তা
,৮১৩ কি.মি.
প্রাণীসম্পদ হাসপাতাল
১১টি
আবাসন/আশ্রয়ণ প্রকল্প
০২টি
আদর্শ গ্রাম
০৯টি
খেয়াঘাট/নৌকাঘাট
১২৪টি
সুনামগঞ্জ জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য:
সুনামগঞ্জের পল্লী ও লোক সংস্কৃতিতে আমরা পাই মাঝির ভরাট গলার গান, রাখালের বাঁশির সুর। এছাড়া হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অসংখ্য আউল, বাউল, পীর, ফকির, দরবেশ, বৈষ্ণব-সন্ন্যাসীদের অসংখ্য সৃষ্টিশীল গান যা মানুষকে পরমেশ্বরের সন্ধান পেতে সাহায্য করে। এগুলোও আমাদের এক মূল্যবান রত্নভান্ডার। বার মাসে তের পার্বণে ভরপুর হিন্দুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তাদের রয়েছে বিভিন্ন বর্ত, মেলা ও উৎসবাদি। মুসলিম সম্প্রদায়ের রয়েছে গাজির গীত, মহররমের গান, মর্শিয়া, কাওয়ালী ইত্যাদি। এছাড়া এখানকার লাঠি খেলা ও নৌকা দৌড় এককালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। আজো এর রেশ শেষ হয়ে যায়নি। থিয়েটার, নাটক, যাত্রা ও কবি গানের লড়াইতো আছেই। এক কথায় জারি সারি ভাটিয়ালীর দেশ আমাদের সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের সংস্কৃতিতে যাঁরা সম্মানিত করতে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে হাছন রাজা, রাধারমন, দূর্বীণ শাহ, শাহ আব্দুল করিম, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, মহসিন রেজা চৌধুরী, মনিরুজ্জামান মনির, নির্মুলেন্দু চৌধুরী, আব্দুল হাই, ব্রহ্মানন্দ দাস, লালানিরেন্দু দে, বিপীন পাল, ক্ষিরোদ শর্মা, তরণী কান্ত দে, ছাদির উদ্দিন আহমদ, শাহ আবু তাহের প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য।
সুনামগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান ।
ছবির মতো সুন্দর এবং বৈচিত্রময় সুনামগঞ্জ জেলা।এই জেলায় অনেক দর্শনীয় স্থান আছে ।তার মধ্যে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান উল্লেখ করা হলো।

১।শাহ আরেফিনের আস্তানা, ২।টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প, ৩।পনাতীর্থ স্থান তাহিরপুর, ৪।যাদুকাটা নদী, ,৫।শনির হাওর, ৭।হাছন রাজা মিউজিয়াম ৮।সুখাইড় জমিদার বাড়ি, ৯।গৌরারং জমিদার বাড়ি , ১০।নারায়ণতলা,১১।ডলুরা শহীদদের সমাধি সৌধ,১২।পাগলা মসজিদ, দক্ষিন সুনামগঞ্জ ,১৩।পাইলগাঁও জমিদার বাড়ি , ১৪।টাঙ্গুয়ার হাওর ও ১৫। সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য যাদুঘর


১। শাহ আরেফিনের আস্তানা: হযরত শাহজালাল (রহঃ) একদিন স্বপ্নযোগে রাসুলে পাক (দঃ)-এর পক্ষ থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের গৌড় রাজ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য আদেশপ্রাপ্ত হন। তিনি এই স্বপ্নের কথা তাঁর স্বীয় মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহঃ)-এর কাছে বলার পরে তিনি হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর হাতে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন- ‘যে মাটির রং ও গন্ধ এই মাটির সঙ্গে মিলবে সেখানেই তুমি অবস্থান নেবে এবং সেখান থেকেই তুমি ধর্ম প্রচার করবে।’ তিনি সিলেটে এসে ধর্ম প্রচার করেছিলেন ।হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর সাহচার্য পাওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসতে লাগলো এবং তিনি তাদের ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানদান করেন।
হযরত শাহজালাল (রহঃ)মাজার
তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনার্থে তিনি তার শিষ্যদের বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচারের আদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেন। তাঁর ৩৬০ আওলিয়ার একজন হলেন হযরত শাহ আরেফিন (রহঃ),যিনি আমাদের অনেকের কাছেই জিন্দা পীর হিসাবে পরিচিত,
অনেকেই নাকি উনাকে দেখেছে,অনেক গল্প আছে উনাকে নিয়ে তার সত্যতা একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন,তবে সব অলী আওলিয়ার মাঝেই অনেক গুন সমৃদ্ধ,অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে,হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর জীবনে অনেক ঘটনা আজো মানুষের মুখে মুখে তেমনি তাঁর ভক্তকুল এবং তাঁর শিষ্যদেরও অনেক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল,সেই ক্ষমতা এই অলীর ছিল। হযরত শাহ আরেফিন (রহঃ) এর মূল আস্তানা ভারতের খাসিয়া পাহাড়ে হলেও সেই সীমান্ত সংলগ্ন সুনাগঞ্জের তাহিরপুরেও নাকি ওনার পদচারণা ছিল। তবে পাহাড়ের যে প্রান্তে উনার মাজার সে জায়গা টা অনেক ঢালু এবং পিচ্চিল,আর উনাকে নাকি অনেকেই ওখান থেকে এসে জাদুকাটা নদীতে অজু করতে দেখেছেন আর সেখানেই এখন তার মাজার রয়েছে,হাজারো ভক্ত এই মাজারে আসেন,দোয়া নেন আর মাজার জিয়ারত করেন,প্রতি বছর একবার এখানে ওরস হয়। তিনি কবে কত সালে এখানে এসেছিলেন তাঁর কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি,তার কোন বংশধর ছিল কিনা তাও জানা যায়নি তবে শুনা যায় তিনিও তাঁর গুরু হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর মত চিরকুমার ছিলেন,তার অনেক কেরামতির কথা লোকমুখে শুনা যায়,যারা তাকে দেখেছে বলে বয়ান দেয় তারা বলেছে উনাকে সাদা কাপড়,মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি আর হাতে তজবি নিয়ে হেটে যেতে দেখেছে পাহাড়ের দিকে,তার কতটুকু সত্য তা আল্লাহ পাক ভাল জানেন,আমাদের এলাকায় বালি পাথরের শ্রমিক বেশি,তারাই নাকি অনেক রাতে বারকি নিয়ে পাহাড়ে ঢোকার পথে উনাকে দেখেছে,অনেকে আবার উনার দ্বারা উপকৃত হয়েছে তেমন গল্পও আছে। তবে আল্লাহর অলীরা সদা সর্বদা মানুষের কল্যানে কাজ করে গেছেন। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার লাউড়ের গড় এলাকায় উনার বিচরন ছিল তাই সেখানে তাঁর নামে আস্তানা বানানো হয়েছে।

শাহ আরেফিন (রহঃ)এর আস্তানা
লাউড় রাজ্যের মাটি ও মানুষ এর কল্যানে তিনি তাঁর ধর্ম পালন করে গেছেন আর পাশাপাশি দীক্ষা দিয়ে গেছেন তাঁর শিষ্যদের,এখনো হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত তাঁর মাজার জিয়ারত করতে এবং তাদের মানত পুর্ন করতে এই লাউড়ের গড় আসেন।
২।টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প : তাহিরপুরের টেকেরঘাট চুনাপাথরের প্রাকৃতিক ভান্ডারেও রয়েছে তেমনি এক অপরূপ সৌন্দর্য্য। বিচিত্র উপায়ে চুনাপাথর সংগ্রহের পদ্ধতি সত্যিই বিস্ময়কর। মনোমুগ্ধকর বললেও অত্যুক্তি হবে না। সিমেন্ট শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই চুনাপাথরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে গ্রামীণ আবহে পাহাড়ী খনি অঞ্চল। একদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্য থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ প্রক্রিয়ার আধুনিক আয়োজন। অন্যদিকে বিশাল বিস্তৃত হাওর। দিগন্তে মেশা সবুজ ধানের মাঠ সত্যিই প্রকৃতির সাজানো এক মনোরম আঙ্গিনা। চুনাপাথর শিল্পকে ঘিরে টেকেরঘাটে মানুষের জীবন যাত্রায়ও এসেছে ভীন্নতা।

সাধারনত প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চুনাপাথর সংগ্রহের কাজ চলে। এছাড়া বন্ধ থাকে সংগ্রহ। টেকেরঘাটের বড়ছড়া দিয়ে কয়লা আমদানি করা হয়ে থাকে ভারত থেকে। প্রতি বছর ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা আমদানি হচ্ছে এই শুল্ক স্টেশন দিয়ে।। ভারতের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ী অধিবাসীদের কয়লা আহরণ পদ্ধতি, বিচিত্র জীবনধারা সত্যিই চমৎকার বিষয়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনি দেখে আসতে পারেন পাহাড়ী অধিবাসীদের ভারতীয় ভূখন্ড। পাহাড়ী বন্ধুদের জীবন ধারা আপনাকে নাড়া দেবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আপনি এক নতুনের আলিঙ্গনে আপ্লুত হবেন। ভাললাগার এক ভীন্ন শিহরণ আপনাকে শিহরত করবে টেকেরঘাটে।

টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প
এই অঞ্চলে যাতায়াত করতে হলে বর্ষাকালই উত্তম। বর্ষাকালে শহরের সাহেব বাড়ি নৌকাঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পীড বোটযোগে সরাসরি টেকেরঘাট যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘন্টায় এবং স্পীড বোটে ২ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ইঞ্জিন বোটে খরচ হয় ২,০০০টাকা থেকে ২,৫০০ টাকা পক্ষান-রে স্পীড বোডে খরচ হয় ৭,৫০০ টাকা থেকে ৮,০০০ টাকা। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে রাত্রি যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই। তবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকলের রেস্ট হাউজে অবস্থান করা যায়। গ্রীষ্মকালে শহরের সাহেব বাড়ি খেয়া ঘাট পার হয়ে অপর পাড় থেকে মোটর সাইকেল যোগে ২ ঘন্টায় টেকেরঘাট যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ভাড়া মোটর সাইকেল প্রতি ৩০০ টাকা।

৩।পনাতীর্থ স্থান তাহিরপুর :হিন্দুধর্মের সাধক পুরুষ অদৈত মহাপ্রভুর মা লাভা দেবীর গঙ্গা স্নানের খুব ইচ্ছাছিল। কিন্তু শারীরিক সামর্থের অভাবে ইচ্ছা পুরনের সম্ভাবনা ছিল না। অদ্বৈতমহাপ্রভূ তার মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য যোগসাধনা বলে পৃথিবীর সমস্ত তীর্থেরপূ্ণ্য জল এক নদীতে এক ধারায় প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। এই জলধারাই পুরনোরেনুকা নদী বর্তমানে যা যাদুকাটা নদী নামে প্রবাহিত। তাহিরপুর  উপজেলার এই নদীর তীরে পনাতীর্থে প্রতি বৎসর চৈত্র মাসে বারুনী মেলা হয়।
পনাতীর্থ
এই মেলাবারুনীযোগ বারুনী নামে স্থানীয় ভাবে পরিচিত। প্রতি বৎসর লাখো হিন্দুপুনার্থীর সমাবেশ ঘটে এই বারুণী মেলায়। অনেক মুসলমানও এই মেলা দেখার জন্য পনাতীর্থ যান । আপনিও যেতে পারেন।
৪।যাদুকাটা নদী : পৌরাণিক যুগের কামরূপ রাজ্যের উপ-রাজধানী ছিল লাউড়এক সময় কামরূপ থেকে আলাদা হয়ে লাউড় স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়সেই লাউড় রাজ্যের স্মৃতিমাখা সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে চলেছে সীমান্তবর্তী নদী যাদুকাটাপাহাড় ও সীমান্তঘেঁষা এ নদীটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য আধারসংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা আর একটু পরিচর্যায় এ স্থানটি হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় এক পর্যটনকেন্দ্রএখানে পর্যটন অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে তা সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য খাত হতে পারে বলে স্থানীয়দের ধারণাআধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হলে দেশের বাইরের পর্যটকদেরও কাছে টানতে পারবে যাদুকাটার মোহমায়াসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা আর পরিচর্যার অভাব থাকলেও প্রকৃতি এ এলাকাকে সাজিয়েছে অকৃপণভাবেদুদিকের ঘন বন-পাহাড়ের ছায়ায় যাদুকাটা যেন অথৈ নীলের ক্যানভাস
পাহাড়ের ছায়ায় যাদুকাটা যেন অথৈ নীলের ক্যানভাস
সকাল-সন্ধ্যা স্রোত-ঢেউহীন এই নদীর মৌনতা পাহাড়ি ঠাণ্ডা বাতাসে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেনদীর তলদেশে চিকচিক করে বালু আর নুড়িপাথরযাদুকাটার উত্পত্তিস্থলের অদূরেই রয়েছে একটি ছোট টিলাবারেকের টিলানামের এ টিলাটি রূপের নদী যাদুকাটার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণনদীঘেঁষে খাড়া ও ঢালু পথ বেয়ে উঠতে হয় এই সবুজঘেরা টিলায়ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় থেকে যাদুকাটা নদীর উত্পত্তিএ নদীর আদি নাম রেণুকাকথিত আছে, নদীতীরবর্তী কোনো গ্রামের এক বধূ মাছ মনে করে নিজের যাদু নামের পুত্রকে কেটে ফেলেছিলেনআর তখন থেকেই এর নামকরণ হয় যাদুকাটাশ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভু মায়ের ইচ্ছানুসারে এই নদীতে পৃথিবীর সপ্তবারির জল একত্রিত হওয়ার পর থেকে এর নাম হয়পনাতীর্থ
যাদুকাটা নদী
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এখানে দোল পূর্ণিমার রাতে সপ্তবারির জল একত্রিত হয়আর এই বিশ্বাসেই প্রতি বছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে যাদুকাটায় স্নান করার আশায় দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থীরা এসে জড়ো হন নদীতীরে অদ্বৈতেরনবগ্রামেএকে কেন্দ্র করে নদীতীরে অনুষ্ঠিত হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মেলা, বারুণি মেলা
বারকি শ্রমিকের আনাগোনায় মুখর থাকে যাদুকাটা
 
দিনে প্রায় ১০-১৫ হাজার বারকি শ্রমিকের আনাগোনায় মুখর থাকে যাদুকাটাপুরো বছর নদীতে বারকি শ্রমিকরা বালু ও পাথর আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেনআর পুণ্যার্থীদের আনাগোনা তো আছেইসুন্দর এ নদী দেখে তৃষ্ণা মেটাতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরাও আসছেনদর্শনার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে ভোগান্তি পোহাতে হয়
৫।শনির হাওর :বাজে বংশী রাজহংসী নাচে দুলিয়া দুলিয়া নাচে পেখমও মেলিয়া বাজে বংশী. তারে তুমি কইয়ো গিয়া বিষ্যুতবারে তাহার বিয়া আমরা যাবো পানসী নিয়া শনির হাওর পাড়ি দিয়া......এমনি একটি গানের মধ্য দিয়া পরিচয় করিয়ে দিতে চাই আমাদের সুনামগঞ্জের আর এক বিরাট হাওরের সাথে, যার রুপ বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম, বর্ষায় যে হাওর অথই জলের দরিয়া, শীতে সেই হাওরই ঢেউখেলানো সবুজ ফসলের মাঠ, তার নাম শনির হাওর। যে হাওরের রূপ দেখার জন্য এখনি উত্তম সময়,একটি নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন,এক দিনের একটি বনভোজন করে ফেলুন পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে। হয়তো এটিই হতে পারে আপনার জীবনের সুন্দর একটি দিন। জেনে নিন শনির হাওরের বিভিন্ন তথ্য.....
শনির হাওর
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড দেশে ৪১৪টি হাওর আছে বলে তাদের এক দলিলে উল্লেখ করেছে, ভাটির দেশ হওয়ায় আমাদের দেশে হাওর-বাঁওড়ের শেষ নেই। তবে সবচেয়ে বেশি বিলহাওর দেখা যায় বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে।বর্ষা আর
শুষ্ক মৌসুমে এগুলোর রূপ একেবারেই আলাদা। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিয়দংশ প্রভৃতি জেলা নিয়ে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল গঠিত৷ হাওরাঞ্চলের মোট আয়তন ৫ হাজার বর্গমাইল৷ হাওরাঞ্চলের জনসংখ্যা এক কোটিরও বেশি৷ হাওরাঞ্চলে একটিমাত্র ফসল উত্পাদন হয়- যার নাম বোরো ধান৷ বিরল বিচিত্র দেশি জাতের অনেক ধান এখনো এই হাওরাঞ্চলে উত্পাদিত হয়৷
হাওরাঞ্চলে একটিমাত্র ফসল উত্পাদন হয়- যার নাম বোরো ধান
বছরে আড়াই লাখ টন ধান উত্পাদন করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায় হাওরবাসীরা৷ দেশের চাহিদা মিটাতে এবং দেশে আয়তনের দিক থেকে বিশাল কয়েকটি হাওরের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুনামগঞ্জ জেলার এই শনির হাওর। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণে এ হাওরের অবস্থান। বিশ্বম্ভরপুর ,তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলা নিয়ে শনির হাওর অবস্থিত। আয়তন ৬৬৩৮ হেক্টর। হাওরের চারদিকে প্রায় ৬০টি গ্রাম আছে। হাওরটির পুর্বে রক্তিনদী ও উত্তর পশ্চিম দিকে বৌলাই নদী। তবে একসময়ের যৌবনা বৌলাই এখন মরানদী হয়ে হাওরের সমান হয়ে গেছে। হাওরের প্রায় ৪০ভাগ উচু জমি সেচের অভাবে অনাবাদী পড়ে থাকে। নদী ভরাট হওয়ায় পানি টানতে না পারায় জলাবদ্ধতাও একটি বড় সমস্যা। এই হাওরে ১১টি বিল আছে। বিলগুলো হল সোনাতলাবিল, বড়বিল, সেফটিবিল, রামচন্নাবিল, ফেলবাঙ্গাবিল, কালির ঘেউবিল, দিঘাফছমাবিল, দাওয়াবিল, টুলিবাড়িবিল, তিনবিল ও আরাবাদিবিল। এসব বিলৈ প্রচুর পরিমান দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বিলগুলো প্রকৃত জেলেরা ছাড়া প্রভাবশালীরা ইজারা নেয়। মাছ ধরা থেকে প্রতিবছর জেলেরা বঞ্চিত থাকে। শনির হাওরে বর্তমানে শুধু বোরোধান চাষ হয়। তবে এক সময় এ হাওরে গোল আলু , মিষ্টি আলু, সরিষা,গম ও পাট চাষ হত। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ আর প্রকৃতির অপরূপ লীলা নিকেতনের অসামান্য চারণভুমি ভাটিবাংলা খ্যাত হাওর অঞ্চল৷ বাংলাদেশের অনেক মানুষ এই হাওরের সম্ভাবনার কথা জানেনা৷ কারণ হাওর নিয়ে তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণা নেই৷ নেই লেখালেখি, গবেষণা, ও আলোচনা৷ হাওর বাসীর সুখ-দুঃখ, সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে তেমন কোনো ভাবনার প্রতিফলন নেই সরকারি ক্ষেত্রেও৷ অথচ এই বাংলাদেশে ধান এবং মাছের চাহিদা পূরণে যুগে যুগে অবদান রেখে আসছে ভাটিবাংলার মানুষ- হাওরবাসী৷ সুখ্যাতি হিসেবে এই ভাটিবাংলা বা হাওড়রাঞ্চলকে শস্য ভান্ডারও বলা হয়ে থাকে৷
হাওড়রাঞ্চলকে শস্য ভান্ডারও বলা হয়ে থাকে
ছোট ছোট নদী, খাল-নালা, ডোবা আর বিস্তির্ন এলাকাজুড়ে বিল মিলিয়ে এই হাওরাঞ্চল ভাটিবাংলাকে যেন পরম মমতায় প্রকৃতির অপরূপ রূপে সাজিয়েছে৷ হাওরের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা ঋতুতে ঋতুতে পরিবর্তন হয়৷ বর্ষার ৭ মাস দিগন্ত বিস্তৃত অথৈ জল, উদ্দাম ঢেউয়ের অবিরাম মাতামাতি আর মন পাগল করা মাতাল হাওয়া যেকোনো পর্যটকের মন উদাস করে দেবে৷ এই হাওর অঞ্চলে একটু দৃষ্ঠি দিলে খোলে দিতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা, যা না দেখলে বিশ্বাস হয়না তা হল হাওর, এর কি রুপ, এর কি বিশালতা, এর কি হুংকার।এই জলের তলে ভাটিবাংলার স্বর্ণগর্ভা সোনালী ফসলের মাঠ৷ হাওর এলাকায় বর্ষার জলকেলি যিনি জীবনে একবার হাওর দেখেছেন- তিনি বার বার ফিরে যাবেন হাওরের টানে৷ বর্ষায় যৌবনবতী হাওর সাগরের মতো অনন্ত অসীম জলাধার৷ দূরের আকাশ আর পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য হৃদয়কাড়া৷ হাওরে নৌকা ভ্রমণে চাঁদসুন্দর রাতের স্মৃতি জীবনে একবার গেঁথে নিলে আমৃত্যু সে তৃষ্ণা থেকে যাবে৷ তাই এই হাওরাঞ্চল বা ভাটিবাংলা হতে পারে অপার সম্ভাবনার পর্যটন শিল্পকেন্দ্র৷ শুধু রূপ নয়- গুণ তার অনন্ত অসীম সম্পদ সম্ভাবনার৷ হাওরাঞ্চলে ৬/৭ মাস থাকে পানি৷ বাকি সময় শুকনো সবুজ প্রান্তর৷ অসীম সম্ভাবনার এই হাওরাঞ্চলে কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ৫০ লাখের অধিক জনসংখ্যা বছরের প্রায় ছয় মাস বেকার সময় কাটায়৷ এ দেশের প্রায় পাঁচ হাজার হাওর-বাওর, বিল-ঝিল নিয়ে এই হাওরাঞ্চল৷ হাওরবাসীর প্রায় ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠি কৃষিকাজ করে৷ বাকি ১০ ভাগের ৫ভাগ মত্স্যচাষ আর ৫ ভাগ ব্যবসা, চাকরি ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত৷ হাওর অঞ্চলের আরেক অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদের নাম মাছ৷ দেশের আহরিত মাছের শতকরা ২৫ ভাগ হাওরাঞ্চল থেকে আহরণ করা হয়৷ বছরে প্রায় ১০০ কেটি টাকার অধিক মাছ পাওয়া যায় হাওরে৷ ৷ সুতরাং হাওরের এই অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগাবার কথা ভাবতে হবে এখনই৷ হাওরের জলাবদ্ধ ভুমিতে জন্মে নল-খাগড়া, ইকরা, জিংলা, বাঁশ এবং প্রচুর বনজসম্পদ৷ এখানে আছে জলনিমগ্ন হিজল ও করচের বাগ৷ এসব উত্সকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে দেশীয় শিল্প কারখানা৷
হাওরাঞ্চল যখন শুকিয়ে যায় তখন এর পানির সাথে বেড়ে ওঠা বাহারি প্রজাতির দেশীয় মাছ সব গিয়ে জমা হয় হাওরের নিম্নাঞ্চলে৷ এই নিম্নাঞ্চলকে বলা হয় বিল স্থানীয় ভাষায় ‘জলমহাল’৷ তখন জলমহালগুলো টইটম্বুর থাকে মাছ আর মাছে৷ জলমহালে কি পরিমাণ মাছ থাকে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবেনা৷ ৷ হাওরাঞ্চলের জলরাশিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জাতের মাছ যেমন কৈ, সরপুঁটি, পুঁটি, তিতপুঁটি, কাতলা, মাগুর, খৈলসা, বাঁশপাতা, আইড়, টেংরা, বাইম, চিতল, ভেদা, পাবদা, গজার, শোল, মহাশোল, চাপিলা, কাকিলা, বোয়াল, মৃগেল, রুই, কালবাউস প্রভৃতি৷
হাওর শুধু মাছ আর ধান নয়- পাখির জন্য অভয়ারণ্য এলাকা৷ শুকনো মৌসুমে বিশেষত শীতকালে দেশের বিরল প্রজাতির বহু পাখির দেখা মিলবে হাওরের বদ্ধ জলাশয়ে৷ হাওরের হিজল বাগে বসে পাখিদের মিলনমেলা৷ এ এক অভুতপূর্ব দৃশ্য৷ অনেকেই এ হাওরকে সম্পদ ও সৌন্দর্যের রাণী হিসেবে অভিহিত করেন

৭।হাছন রাজা মিউজিয়াম: (জন্ম ১৮৫৪ মৃত্যু ১৯২১ খ্রিঃ) সুনামগঞ্জ পৌরসভা এলাকার তেঘরিয়ায় সুরমা নদীর কোল ঘেষে দাড়িয়ে আছে হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। এ বাড়িটি একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান। হাছন রাজা মূলত ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত জমিদার। মরমী সাধক হাছন রাজা জীবনে অসংখ্য গান রচনা করে আজ অবধি লোকপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছেন।


কালোর্ত্তীণ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই নিজের হাতের লেখা কবিতার গানের পান্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগ আপ্লুত করে এই মরমী কবির রচিত গানে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাছন রাজাকে পত্র মাধ্যমে অভিনন্দন প্রশংসা জানিয়েছিলেন


হাসন রাজার মিউজিয়াম


সুনামগঞ্জ পৌর এলাকাধীন গাজীর দরগা নামক পারিবারিক কবরস্থানে প্রিয়তম মাযার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মরমী কবি হাছন রাজা হাছন রাজার মাজার দেখার জন্য প্রতি বৎসর বহু দর্শনার্থীর সমাগম হয়

৮।সুখাইড় জমিদার বাড়ি:
৩০০বছরেরও বেশি পুরোনো মোগল আমলের এই স্মারক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, পাহাড়ি বৌলাই নদী, বিশাল বিশাল হাওর, পাখি, জঙ্গল সবদিক বিবেচনায় সুনামগঞ্জের সুখাইড় জমিদার বাড়ি ভাটি বাংলার রাজমহল হিসেবে কালের স্মৃতি নিয়ে আজো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, এই জমিদার বাড়িতে ছিল আকর্ষণীয় বাংলো, জলসাগর, গুদামঘর, কাচারিঘর, রেস্টহাউস ও চারটি থাকার ঘর। সদ্য অতীতে তা বিলীন হলেও এখনও বেশ আকর্ষণীয় এ জমিদার বাড়িটি।
সুখাইড় জমিদার বাড়ি ভাটি বাংলার রাজমহল
কথিত রয়েছে, সুখাইড় জমিদারির সীমানা গজারিয়া নদীর উত্তরপাড় থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে জমিদারদের বিরুদ্ধে যে নানকার বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল তার সূত্রপাত সুখাইড় জমিদার বাড়ি থেকেই। যার ইতিহাস খুজলে দেখা যায়, আনুমানিক ১৬৯১ সালে মোঘল শাসনামলে মহামানিক্য দত্ত রায় চৌধুরী হুগলী থেকে আসাম যাওয়ার পথে কালিদহ সাগরের স্থলভূমি ভাটির প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে সুখাইড়ে জায়গা কেনেন।
সুখাইড় জমিদার বাড়ি
ঐ সময় থেকেই সুখাইড়ে বাড়ি নির্মাণ পরিকল্পনা শুরু করেন মহামাণিক্য। পাশে পাহাড়ী নদী বৌলাই, হাওরের থৈ থৈ ঢেউ, বন ঝোপ আর সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশে সমৃদ্ধ থাকায় ১৬৯৫ সালে সুখাইড়ে ২৫ একর জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন জমিদার মোহনলাল। কয়েক পুরুষের চেষ্টায় শেষ হয়েছিল বাড়ির নির্মাণকাজ। জমিদারি যুগে সুনামগঞ্জ ছিল ৩২ টি পরগনায় বিভক্ত। দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর কারণে সুখাইড় জমিদার বাড়ি হাওর রাজ্যের রাজমহল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এ জমিদারির বিস্তৃতি ছিল দক্ষিণে ঘাগলাজুর নদীর উত্তরপাড়, উত্তরে বংশীকুন্ডা, পশ্চিমে ধর্মপাশা এবং পূর্বে জামালগঞ্জ। এক সময় এ বাড়ির মালিকানায় ছিল ধানকুনিয়া বিল, চারদা বিল, কাইমের দাইড়, সোনামোড়ল, পাশোয়া, ছাতিধরা, রাকলা, বৌলাই, নোয়ানদী, চেপ্টা এক্স হেলইন্নাসহ ২০ টি জলমহল। জমিদারদের আয়ের উৎস বলতে প্রজার ওপর ধার্যকৃত খাজনা আদায় ও হাওরের মতস্য খামার এবং বন জঙ্গল৷ প্রজাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন-ক্ষমতার অপব্যবহার ৷ সুন্দরী মেয়ে, ঘরের বধূদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়লে রেহাই পেতো না৷ ধীরে ধীরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে৷ আর আজো সেসব রসময় কাহিনী অত্যাচার-নির্যাতন-প্রভাবের গল্প গ্রামাঞ্চলে কল্পকাহিনীর মতো ছড়িয়ে আছে৷ জমিদারি প্রথার শেষ দিকে নানকার বিদ্রোহের পটভূমি তারই অংশ৷ প্রজাদের ওপর জমিদারদের স্বর্ণময় সময়ে যে অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্মমতার ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এখন যেন তারই ফল ভোগ করে চলেছেন জমিদারদের বর্তমান বংশধরর। জমিদার বাড়ির জুলুসহীন রূপের মতোই তাদেরও জীবনযাপন আভরণহীন৷ বড়োবাড়িতে বাস করছেন মলয় চৌধুরী, মধ্যম বাড়িতে শিপু চৌধুরী ও ছোট বাড়িতে বিমল চৌধুরী৷
অযত্ন অবেহেলা ও সরকারের উদাসীনতায় প্রত্নতত্বের সম্ভাবনাময় স্থান এবং মোগল আমলের নিদর্শনসমূহ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। জলসাঘর, বৈঠকখানা, বাংলা, বিশ্রামাগার, দুর্গামন্দির ইতিমধ্যে ধসে গেছে৷
সুখাইড় জমিদার বাড়ি
এককালে যে জমিদার বাড়িকে আবর্তিত করে পরিচালিত হতো প্রজাব্যবস্থা তার চার ভাগের মধ্যে এখনো বড়ো বাড়ি, মধ্যম বাড়ি ও ছোট বাড়ি টিকে আছে৷ জমিদারি পতনের পর বাড়িগুলোর অনেক বদ্ধ ঘর ও সিন্দুক রয়েছে যা আজো খোলা যায়নি৷ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে এখনো গা ছমছম করে৷ অন্ধকার থাকে এককালের রঙিন আলো ও শোভাদানকারী কক্ষসমূহ৷ বর্তমান বংশধররা জানান প্রাচীন আমলের মাটির নিচে যে ঘরগুলো ব্যবহার হতো এখন কেউ সাহস করে বন্ধঘর খুলতে সাহস পান না৷ তেমনি অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাড়ির দেয়ালের নান্দনিক কারুকার্যসমূহ৷ কথিত আছে জমিদারি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ইংরেজ প্রশাসক মি. বেলেন্টিয়ার৷ তিনি বেরিয়েছিলেন অদূরবর্তী টাঙ্গুয়ার হাওরে শিকার করতে৷ তখনকার ঘটনা শিকারের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল প্রথম সাহেবরা গুলি চালাবার পর জমিদারদের গুলি করা, সে সময়ই বেলেন্টিয়ার সাহেবের হাতিকে ৩টি বাঘ আক্রমণ করে৷ মুহূর্তের আকস্মিকতায় ইংরেজ সাহেব জ্ঞান হারান। সে অবস্থার সুখাইড়ের জমিদার মথুর চৌধুরী দিগ্বিদিক কিছু না ভেবেই তিনটি বাঘকে গুলি করে হত্যা করেন৷ পরে সাহেবের জ্ঞান ফিরলে জমিদারকে নিজের রাইফেলটি উপহার দিয়ে দেন৷ এছাড়া জমিদারী আমলের এমন খবরও পাওয়া যায় যে তখন কেউ ছাতা টাঙিয়ে, জুতা পায়ে দিয়ে জমিদার বাড়ীর সামনে দিয়ে গেলে বেয়াদবী মনে করা হতো, ফলাফল শাস্তি।
সুখাইড় জমিদার বাড়ি
কিন্তু কতকাল আর অন্যায় অত্যাচার সহ্য করা যায় । ১৯২২-২৩ সালে সুখাইড়ে গড়ে উঠা প্রবল নানকার বিদ্রোহ কিন্তু জমিদারী প্রথার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। এমন অনেক কাহিনী বিজরিত এই জমিদার বাড়ি, অনেক ঐতিয্য আর সুন্দর স্মৃতি নিয়া দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সুনামগঞ্জে। আমরা সবাই মিলে যদি এখনো এসব কাহিনী আর ঐতিয্যময় স্থাপত্য সবার সামনে তুলে ধরতে পারি তবে একসময় সুনামগঞ্জ হয়ে উঠবে বিশাল সুন্দর পর্যটন নগরী আর এছাড়াও সুনামগঞ্জের পুরো ইতিহাস দেশবাসীকে জানানো উচিত বলে মনে করি।

৯। গৌরারং জমিদার বাড়ী: সুনামগঞ্জ শহর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে গৌরারং গ্রামে গৌরারং জমিদার বাড়িটির অবস্থান। ৩০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছয়টি বিরাট বিরাট অট্টালিকা নিয়ে গৌরারং জমিদারবাড়ি।
গৌরারং জমিদার বাড়ি
কালের বিবর্তনে জমিদারবাড়িটি আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে বসেছে। কয়েকযুগ আগে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও জমিদারদের কিংবদন্তী আজো ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। তবে সে ইতিহাস এখন অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ তথা এই অঞ্চলের অত্যন্ত প্রভাবশালী এই জমিদারির পত্তন করেন জামিদার রাম গোবিন্দ চৌধুরী, রাজ গোবিন্দ চৌধুরী ও রাধাকান্ত রায় চৌধুরী নামে তিন ভাই। ১৮০০ সালে এই জমিদারির প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে জানে স্থানীয়রা। প্রায় দুইশ’ বছরের পুরোনো দালানগুলো এখন কালর অত্যাচারে ভেঙ্গে পড়ছে।
 দুইশ’ বছরের পুরোনো দালানগুলো
ইতিমধ্যে দালানের গায়ে শ্যাওলা ধরে দেয়ালগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ির রংমহলের দেওয়ালে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নির্মিত নর-নারী ও লতাপাতার ছবি আজো দর্শকদের আকৃষ্ট করে। প্রায় একশ বছর আগে ভূমিকম্পে জমিদার বাড়িটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় ভূমিকম্পে দেওয়াল চাপা পড়ে জমিদারের এক ভাই মারা গিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী এই জামদারবাড়ির মূল ফটকসহ বেশ কিছু স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলে। জমিদার বাড়ির সামনের এক পাশে রয়েছে দীঘি। দীঘিতে জমিদার বাড়ির নারীদের যাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল জলবারান্দা। দেওয়ালঘেরা এ জলবারান্দা দিয়েই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গোসল করতেন জমিদার বাড়ির নারীরা। জমিদারদের উত্তরাধীকারদের মধ্যে এখন আর কেউ এখানে থাকেন না। জমিদার রাম গোবিন্দ চৌধুরীর কয়েক প্রজন্ম পরের উত্তরসূরি নগেন্দ্র চৌধুরী ছিলেন এ অঞ্চলের প্রতাপশালী জমিদার। তার পুত্র নিরঞ্জন চৌধুরী পরিবার পরিজন নিয়ে এখন সুনামগঞ্জ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ছেলে অঞ্জন চৌধুরী, ছেলের বউ লিপি শ্যাম ও একমাত্র নাতি অয়ন চৌধুরী। সুনামগঞ্জ শহরের প্রাচীন রাজ গোবিন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জমিদার রাজ গোবিন্দর নামানুসারেই স্থাপিত। গৌরারং জমিদার বাড়িতে এক সময় দোল পূর্ণিমা, দুর্গা উৎসবসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু এখন আর এসব কিছুই হয় না। জমিদারবাড়ির সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে গেছে। বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে জমিদারদের বেশিরভাগ জমি। 

১০।নারায়ন তলা: সুনামগঞ্জ উপজেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নারায়ণতলা এর আশেপাশের অঞ্চল শহর থেকে ১২ কি. মি. দূরে একদম সীমান্ত ঘেঁষে মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান নারায়ণতলায় গেলে আপনাকে প্রথমেই স্বাগত জানাবে বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড় তবে পাহাড়গুলো দুচোখ জুড়িয়ে দেখার সুযোগ পেলেও চড়ার সুযোগ কিন্তু হবে না কারণ- বড় পাহাড়গুলোর অবস্থান সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে এজন্যে অবশ্য মন খারাপ করার কিছু নেই সীমান্তে দাঁড়িয়ে অন্য একটি দেশ দেখার মজাও কিন্তু কম নয় সীমানা নির্ধারক পিলারের এপার-ওপারে পা রাখার আনন্দও এখানে বোনাস হিসেবে পাওয়া যাবে নারায়ণতলা যে শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়ে অনবদ্য তা কিন্তু নয়, ঐতিহাসিক দিক দিয়েও স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ, নারায়ণতলার ডলুরায় বৃক্ষরাজীর শীতল ছায়াতলে ৪৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মুক্তিযুদ্ধে বালাট সাব সেক্টরের অধীন যোদ্ধাদের গণ কবর ডলুরার শহীদ মাজারে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেও অসংখ্য দর্শনার্থী প্রতিদিন ভিড় জমান নারায়ণতলার, মুগাইর পাড় গ্রামটি গারো অধ্যুষিত এখানে এলে পাবেন গারো সমাজ সংস্কৃতির সংস্পর্শ
নারায়ণতলা
সীমানা নির্ধারক পিলার

এছাড়া নারায়ণতলায় রয়েছে খ্রিস্টান মিশনারী পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিশনটি পরিচিত সাধু টমাসের গির্জা নামে এছাড়া ডলুরার পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা চলতি নদীও পর্যটকদের জন্যে বেশ আকর্ষণীয়
চলতি নদীর তীরবর্তী বিশাল বালুকাময় প্রান্তরকে মনে হয় বেলাভূমি সব মিলিয়ে নারায়ণতলার সৌন্দর্য অনবদ্য চমৎকার স্থানটিতে যেতে হলে প্রথমে নৌকায় সুরমা নদী পার হয়ে যেতে হবে হালুয়া ঘাট, এখান থেকে রিক্সায় নারায়ণতলায় যাওয়া যায়

১১।ডলুরা শহীদদের সমাধি সৌধ

সুনাগঞ্জ জেলা সদরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদী পেরিয়ে উত্তরে মেঘালয় পাহাড়ের দিকে ১০ কি.মি. এর মতো এগিয়ে গেলে এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মন্ডিত স্থান ডলুরা। একদিকে মেঘালয় পাহাড়, আরেক পাশে পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী ‘চলতি’ এবং দীর্ঘ বালিয়াড়ি। এই স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও উল্লেখযোগ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে এখানে। যেখানে গেলে মুহূতেই ৪৮ জন মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় অন্তত চোখে ভাসে তার নাম ডলুরা। পাহাড়ের পাদদেশে চলতি নদীর তীরে লুকায়িত আছে সেই একাত্তরের রক্তত্যাগ সংগ্রামের স্মৃতি চিহ্ন।
ডলুরা শহীদদের সমাধি সৌধ
মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জের ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধে সীমান্তবর্তী ডলুরা ছিল সুনামগঞ্জের অন্যতম রণাংগন। এই রণাংগনটি ছিল ৪ নং বালাট সেক্টরের অধীন। উক্ত রণাংগনে সম্মুখ সমরে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন তাদের কয়েকজনকে এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে ৪৮ জন শহীদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে “ডলুরা শহীদদের সমাধি সৌধ”।
 
১২।পাগলা মসজিদ, দক্ষিন সুনামগঞ্জ: সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পার্শ্বে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাগলা নামক স্হানে মহাসিং নদীর তীরে পাগলা মসজিদ অবস্হিত মূলত নির্মাণশৈলী অপূর্ব কারুকাজের জন্য এই মসজিদটি বিখ্যাত এলাকার ব্যবসায়ী ইয়াসীন মির্জা ব্যবসা উপলক্ষে তিনি ভারতের কলকাতাসহ নানা জায়গায় ভ্রমণ করতেন ভ্রমণের সুবাদে বিভিন্ন জায়গার স্হাপত্যশৈলী দেখে তিনি এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ১৯৩১ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয় টানা দশবছর কাজ চলে প্রধান মিস্ত্রি আনা হয় কলকাতা থেকে দোতলা মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার, প্রস্হ ৫০ মিটার গম্বুজের উচ্চতা ২৫ ফিট, দেয়ালের পুরুত্ব ১০ ফিট মসজিদের ৩টি গম্বুজ ৬টি সুউচ্চ মিনার রয়েছে 
মসজিদের ৩টি গম্বুজ ৬টি সুউচ্চ মিনার রয়েছে

 মসজিদের দোতলার ছাদে রেললাইনের স্লিপার ব্যবহার করা হয়েছে তৎকালীন সময়ে নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ১০লাখ টাকা এলাকায় এই মসজিদ রায়পুর বড় মসজিদ নামেও পরিচিত বিখ্যাত পাগলা মসজিদ দোতালায় উঠার সিড়ি দোতালার বারান্দা থেকে দেখা মহাসিং নদী দোতালার প্রবেশদ্বার ইমাম সাহেবের নামাযের স্হান নকশাদার দরজার ঐপাশে প্রতিষ্ঠাতার কবরস্হান দোতালার অভ্যন্তরীণ দেয়ালের বিভিন্ন নকশা গম্বুজের ভিতরের নকশা দেয়ালের দামী পাথর ব্যবহার করা হয়েছে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দোতলা থেকে দেখা মসজিদ প্রাঙ্গনের নদীঘাট মসজিদের একাংশ
নামাযের স্হান নকশাদার

১৩।পাইলগাঁও জমিদার বাড়ি:
প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও জমিদারবাড়ী প্রায় সাড়ে একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত তিন শত বছরেরও বেশী পুরানো জমিদার বাড়ীটি অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন জমিদার পরিবারের শেষ জমিদার ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধু রী ছিলেন প্র খ্যাত শিক্ষাবিদ রাজনীতিবিদ তিনি ছিলেন সিলেট বিভাগের কংগ্রেস সভাপতি এবং আসাম আইন পরিষদের সদস্য সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় জগন্নাথপুর উপজেলার অধীন নম্বার পাইলগাও ইউনিয়নের পাইলগাও গ্রামে ঐতিহ্যবাহি জমিদারীর অবস্থান

পাইলগাঁও জমিদারবাড়ী

জমিদার বাড়ী দক্ষিণ দিকে সিলেটের কুশিয়ারা নদী বহমান প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অচ্যূতচরণ চৌধুরী পাইলগাও জমিদার বংশের রসময় বা রাসমোহন চৌধুরী হতে প্রাপ্ত সূত্রেলিখেছেন যে; পাইলগাওয়ে বহুপূর্বকালে পাল বংশীয় লোক বসবাস করত গোষ্টিয় পদ্মলোচন নামক ব্যক্তির এক কন্যার নাম ছিল রোহিণী কোন এক কারণে রাঢ দেশের মঙ্গলকোট হতে আগত গৌতম গোত্রীয় কানাইলাল ধর রোহিণীকে বিবাহ করত গৃহ-জামাতা হয়ে এখানেই বসবাস শুরুকরেন কানাইলাল ধরের আট পুরুষ পরে বালক দাস নামের এক ব্যক্তির উদ্ভব হয় বালক দাস থেকে বংশ বিস্তৃত হয় বালক দাসের কয়েক পুরুষ পর উমানন্দ ধর ওরফে বিনোদ রায় দিল-ীর মোহাম্মদ শাহ বাদশা কর্তৃ চৌধুরী সনদ প্রাপ্তহন বিনোদ রায়ের মাধব রাম শ্রীরাম নামে দুই পুত্রের জন্মহয় তার মধ্যেমাধব রামজনহিতকর কর্মপালনে নিজ গ্রাম পাইলগাঁও এক বিরাট দীঘি খনন করে সুনাম অর্জন করেন তার দেয়া উক্তদীঘি আজও অঞ্চলে মাধব রামের তালাব হিসেবে পরিচিতহচ্ছে মাধব রামের দুই পুত্র মদনরাম মোহনরাম উক্ত মোহনরামের ঘরে দুর্লভরাম, রামজীবন, হুলাসরাম যোগজীবন নামে চার পুত্রের জন্ম হয় এই চার ভাই দশসনা বন্দোবস্তের সময় কিসমত আতুয়াজানের ১থেকে নং তালুকের যতাক্রমে বন্দোবস্তগ্রহন করে তালুকদার নাম ধারণ করে এদের মধ্যে হুলাসরাম বানিয়াচং রাজ্যের দেওয়ানি কার্যালয়ে উচ্চ পদের কর্মচারী নিযুক্ত হন হুলাসরাম চৌধুরী বানিয়াচং রাজ্যের রাজা দেওযান উমেদ রাজার অনুগ্রহে আতুয়াজান পরগণায় কিছু ভূমি দান প্রাপ্ত হন হুলাসরামের প্রাপ্তভূমির কিছু কিছু চাষযোগ্যও কিছু ভূমি চাষ অযোগ্য ছিল পরবর্তিতে হুলাসরাম চাষ অযোয্য ভূমিগুলোকে চাষযোগ্য করে তুললে এগুলোই এক বিরাট জমিদারীতে পরিণত হয়ে উঠে হুলাস রামের ভাতুষ্পুত্র বিজয় নারায়ণের একমাত্র পুত্র ব্রজনাথ চৌধুরী জমিদারি বর্ধিত করে এক প্রভাবশালী জমিদারে পরিণত হন ব্রজনাথ চৌধুরীর দুই পুত্র রসময় সুখময় চৌধুরী রসময় চৌধুরীর পুত্র ব্রজেন্দ্র নারায়নই ছিলেন এবংশের শেষ জমিদার 

১৪।টাঙ্গুয়ার হাওর: বাংলাদেশের  সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হাওর বাংলাদেশর দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি সুন্দরবন

নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল

অবস্থান পরিচিতি

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরা (ঝরণা) এসে মিশেছে এই হাওরে দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি পানিবহুল মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ গ্রামগঞ্জ কৃষিজমি একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে 'রামসার স্থান' (Ramsar site) হিসেবে ঘোষণা করা হয় হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর থেকে হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন
জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর

শীত মৌসুমে পানি শুকিয়ে কমে গেলে এখানকার প্রায় ২৪টি বিলের পাড় (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) জেগে উঠলে শুধু কান্দা' ভিতরের অংশেই আদি বিল থাকে, আর শুকিয়ে যাওয়া অংশে স্থানীয় কৃষকেরা রবিশস্য বোরো ধানের আবাদ করেন এসময় এলাকাটি গোচারণভূমি হিসেবেও ব্যবহৃত হয় বর্ষায় থৈ থৈ পানিতে নিমগ্ন হাওরের জেগে থাকা উঁচু কান্দাগুলোতে আশ্রয় নেয় পরিযায়ী পাখিরারোদ পোহায়, জিরিয়ে নেয় কান্দাগুলো এখন (২০১২) আর দেখা যায় না বলে স্থানীয় এনজিও সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানে পুঁতে দেয়া হয়েছে বাঁশ বা কাঠের ছোট ছোট বিশ্রাম-দণ্ড

জীববৈচিত্র

পাখি
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি স্থানীয় বাংলাদেশী জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর
পাখি
হাওরে প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওড়ে স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস[], কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট (এই হাওরের ২৮-২৯%)[] ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এই হাওরে এছাড়া আছে বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (বাংলাদেশে এর নমুনাসংখ্যা ১০০টির মতো) ২০১১' পাখিশুমারীতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয় এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরিচা ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস; সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও
এছাড়াও প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, প্রজাতির কচ্ছপ, প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বাস, এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর[]
অধ্যাপক আলী রেজা খান-এর বর্ণনানুযায়ী এই হাওরে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি, ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২' বেশি প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০-এর বেশি প্রজাতির সরিসৃপ এবং ১০০০-এরও বেশি প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আবাস রয়েছে

মৎস্যসম্পদ

টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা মাছটির দুটো প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Tortor এবং Torputitora, টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই প্রজাতিই পাওয়া যেত
টাঙ্গুয়ার হাওর

সংরক্ষণ

টাঙ্গুয়ার হাওর
হাওর এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, হাওরের সম্পদ সংরক্ষণ, টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরটি জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আছে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ আনসার সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে সেখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ তবে স্থানীয় প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে একশ্রেণীর অসাধু লোক চুরি করে মাছ শিকার করে এবং তারা মাঝে মাঝে ধরাও পড়ে
১৫।সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য যাদুঘর: সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সম্প্রতি চালু হয়েছে সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য যাদুঘর ।

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব :

সুনামগঞ্জে অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করেছেন। ।তার মধ্যে থেকে কয়েকজন ক্ষণজন্মা প্রখ্যাত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হলো।


শাহ আবদুল করিম    

প্রাথমিক তথ্যাদি : জন্ম ১৫ফেব্রুয়ারি,১৯১৬ সুনামগঞ্জ,বাংলাদেশ মৃত্যু  ১২সেপ্টেম্বর,২০০৯  ধরন  বাউল গান  পেশা  সংগীতশিল্পী  শাহ আবদুল করিম (জন্ম: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ - মৃত্যু: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯) বাংলা বাউল গানের জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে পরিচিত। কালনীর তীরে বেড়ে উঠা শাহ আব্দুল করিমের গান ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও শহরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় মাত্র কয়েক বছর আগে।এপর্যন্তপ্রায়দেড়হস্রাধিকগানলিখেছেন।
শাহ আবদুল করিম
জীবনচরিত
বাউল গানের জীবন্ত কিংবদন্তী শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১]দারিদ্রতা ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। তিনি তাকে আদর করে ডাকতেন ‘সরলা’।
ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়,অবিচার,কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরনা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। যদিও দারিদ্রতা তাকে বাধ্য করে কৃষিকাজে তার শ্রম ব্যায় করতে কিন্তু কোন কিছু তাকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি আধ্যাত্নিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দীন, সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরীয়তী, মারফতি, নবুয়ত, বেলায়া সহ সবধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।

সঙ্গীত সাধনা
স্বল্পশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী এ বছরের প্রথম দিকে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সাম্প্রতিককালে এ সময়ের বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
 
প্রকাশিত বই
বাউল শাহ আবদুল করিমের এ পর্যন্ত ৬টি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হলো- আফতাব সংগীত, গণ সংগীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, কালনীর কূলে এবং দোলমেলা। সম্প্রতি সিলেট জেলা মিলনায়তনে তাঁর রচনাসমগ্র (অমনিবাস)-এর মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে।
শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় কিছু গান
বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গাড়ি চলে না
আমি কূলহারা কলঙ্কিনী
কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
কোন মেস্তরি নাও বানাইছে
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
বসন্ত বাতাসে সইগো
আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু
মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও
আমি তোমার কলের গাড়ি
সখী কুঞ্জ সাজাও গো
জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে
মানুষ হয়ে তালাশ করলে
আমি বাংলা মায়ের ছেলে
রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না

সম্মাননা
বাউল শাহ আব্দুল করিম ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। এছাড়া দ্বিতীয় সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে এই বাউল সম্রাটকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এছাড়াও ২০০০ সালে কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক পান। বাউল সাধক শাহ আবদুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দরিদ্রতার সাথে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এলেও তা যথেষ্ঠ ছিল না।উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে ‘জীবন্ত কিংবদন্তীঃ বাউল শাহ আবদুল করিম’ নামে বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া তার জনপ্রিয় ১২ টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। এই অ্যালবামের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ তাঁর বার্ধক্যজনিত রোগের চিকি‍র জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়।
২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মৃত্যু বরণ করেন।সেই দিন শনিবার সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আব্দুল করিমকে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর থেকেই লাইফসাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল।

 দেওয়ান হাসন রাজা

জন্ম    ডিসেম্বর ২১, ১৮৫৪
তেঘরিয়া, লক্ষণছিরি পরগণা, সিলেট     
মৃত্যু    ডিসেম্বর ৬, ১৯২২ (৬৭ বছর)     
জাতীয়তা    বাংলাদেশী     
অন্য নাম    হাসন রাজা     
পেশা    কবি এবং বাউল শিল্পী    

দেওয়ান হাসন রাজা (২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪ - ৬ ডিসেম্বর, ১৯২২) - (বাংলা- ৭ পৌষ,১২৬১ - ২২ অগ্রহায়ণ,১৩২৯)[১] বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। তাঁর প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্‌ এর প্রধান পথিকৃৎ। এর পাশাপাশি নাম করতে হয় দুদ্দু শাহ্‌, পাঞ্জ শাহ্‌, পাগলা কানাই, রাধারমণ, আরকুম শাহ্‌, জালাল খাঁ এবং আরো অনেকে। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার।
হাসন রাজা

হাসন রাজার বংশধারা

হাসন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সেকালের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। হাসন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর ত্রিতীয় পুত্র। আলী রাজা তার খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাসন রাজার জন্ম[২]। হাসনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তাঁর অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তাঁরই নামের আকারে তাঁর নামকরণ করেন অহিদুর রাজা।
হাসন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু ছিলেন। তাঁদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।[৩] হাসন রাজার পুর্বপুরুষের অধিবাস ছিল অয্যোধ্যায়। সিলেটে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার অধিবাসী ছিলেন।
হাসন রাজার বাল্যকাল :
সিলেটে তখন আরবী-ফার্সির চর্চা খুব প্রবল ছিল। সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা বলে এক বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে তাঁর নামকরণ করা হয়- হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন- হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। মাজহারুদ্দীন ভূঁইয়া বলেন, "বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ে তেমনি সৌম্যদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।"(পৃ. ১৪, ঈদ সংখ্যা 'হানাফী', ১৩৪৪)"। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন।
হাসন রাজার যৌবনকাল :
উত্তারিধাকার সূত্রে তিনি বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন।
প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে, ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরন করিয়ে দিয়েছেন।
হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। 'কুড়া' ছিল তার প্রিয় পাখি। তিনি ঘোড়া পুষতেন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি। মোটকথা, সৌখিনতার পিছনেই তাঁর সময় কাটতে লাগলো। আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তাঁর জীবনের একমাত্র বাসনা। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠলেন।
বৈরাগ্যভাবের সূচনা
হাসন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। কিন্তু এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাসন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাসন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তাঁর চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বর্হিজগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তাঁর প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্‌র প্রেমে মগ্ন হলেন। তাঁর সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এ ভাবেঃ

“    লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়ন দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”  
এভাবে প্রকাশ পেতে লাগলো তাঁর বৈরাগ্যভাব। হাসন রাজা সম্পূর্ণ বদলে গেলেন। জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ডাকসাইটে রাজা এককালে 'চন্ড হাসন' নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন 'নম্র হাসন'। তাঁর এক গানে আক্ষেপের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছেঃ

“    ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন
সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন    ”  
পরিণত বয়সে তিনি বিষয় সম্পত্তি বিলিবন্টন করে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম.ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।

হাসন রাজার সঙ্গীত সাধনা :
হাসন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কতো গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। 'হাছন উদাস' গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান 'হাসন রাজার তিনপুরুষ' এবং 'আল ইসলাহ্‌' সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাসন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তাঁর গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ 'সৌখিন বাহার'-এর আলোচ্য বিষয়-'স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,'মরমী কবি হাসন রাজা')। 'হাছন বাহার' নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
মরমী গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাসনের গান রচিত। ঈশ্বানুরক্তি, জগৎ জীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার খেদোক্তিই তাঁর গানে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে।

মরমীসাধনার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জাতধর্ম আর ভেদবুদ্ধির উপরে উঠা। সকল ধর্মের নির্যাস, সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যই আধ্যাত্ন-উপলব্ধির ভেতর দিয়ে সাধক আপন করে নেন। তাঁর অনুভবে ধর্মের এক অভিন্ন রূপ ধরা পরে- সম্প্রদায় ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতক্রম করে সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করে। হাসন রাজার সঙ্গীত, সাধনা ও দর্শনে এই চেতনার প্রতিফলন আছে। হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্যের যুগল পরিচয় তাঁর গানে পাওয়া যায়। অবশ্য মনে রাখা প্রয়োজন, কয়েক পুরুষ পূর্বে হিন্দু ঐতিহ্যের ধারা হাসন রাজার রক্তে প্রবহমান ছিল। হাসন রাজার মরমীলোকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঠাঁই ছিলোনা। তাই একদিকে 'আল্লাজী'র ইশ্‌কে কাতর হাসন অনায়াসেই 'শ্রীহরি' বা 'কানাই'-য়ের বন্দনা গাইতে পারেন। একদিকে হাসন বলেনঃ

“    আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।    ”  
আবার পাশাপাশি তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হয়ঃ

“    আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।    ”  
হাসনের হৃদয় কান্নায় আপ্লুত হয়,- 'কি হইব মোর হাসরের দিন রে ভাই মমিন',- আবার পাশাপাশি তাঁর ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয় এভাবে,- 'আমি মরিয়া যদি পাই শ্যামের রাঙ্গা চরণ' কিংবা 'দয়াল কানাই, দয়াল কানাই রে, পার করিয়া দেও কাঙ্গালীরে'। আবার তিনি বলেন,' হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা'। স্পষ্টই হাসনের সাধনা ও সঙ্গীতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পুরাণ ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটেছে। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন লালন ও অন্যান্য মরমী সাধকের সমানধর্মা।
হাসন রাজা কোন পন্থার সাধক ছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। তাঁর পদাবলীতে কোন গুরুর নামোল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলেন তিনি চিশ্‌তিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। সূফীতত্ত্বের প্রেরণা ও প্রভাব তাঁর সঙ্গীতে ও দর্শনে থাকলেও, তিনি পুরোপুরি এই মতের সাধক হয়তো ছিলেন না। নিজেকে তিনি 'বাউলা' বা 'বাউল' বলে কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বাউলদের সমগোত্রীয় হলেও নিজে আনুষ্ঠানিক বাউল ছিলেন না। সূফীমতের সঙ্গে দেশীয় লোকায়ত মরমীধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তাঁর সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তাঁর সঙ্গীতরচনার পশ্চাতে একটি সাধন-দর্শনের প্রভাব বলা যায়।

মরমী সাধক দুর্বিন শাহ্ (১৯২১-১৯৭৭)

অচিনা এক জংলা পাখি, থাকে মাটির পিঞ্জিরায়, ধরা দেয় না ঘরে বাইরে, আসা-যাওয়া সর্বদায়’। এমনি বহু জনপ্রিয় গান যিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তিনি মরমী সাধক দুর্বিন শাহ। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লাগোয়া দুর্বিন টিলায় ১৯২১ সালে (বাংলা ১৩২৭ সনের ১৫ কার্তিক) জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা মরহুম সফাত্ শাহ্ও ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধক। ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জকে বলা যায় আধ্যাত্মিক সাধকের চারণভূমি।

মাজার, দুর্বিন শাহ

হজরত শাহজালাল (রা.) এবং হজরত শাহ্পরান (রাঃ)-সহ তিনশ’ ষাট আউলিয়ার পবিত্র স্মৃতিবিজড়িত নিসর্গ-বৈচিত্র্যে ধন্য বৃহত্তর সিলেট জেলা আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা দার্শনিক ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান সিলেট অঞ্চল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘দার্শনিকদের আবাসভূমি’  প্রাচ্যের সেরা সাত দার্শনিক জগন্নাথ মিশ্র, অদ্বৈত আচার্য, ঈশান নগর, বৃন্দাবন দাস, হাসন রাজা, বিপিন পাল, গুরুসদয় দত্ত এই পুণ্যভূমি সিলেটেই জন্ম নিয়েছেন। সুসাহিত্যিক অচ্যুত চরণ চৌধুরী সিলেটকে বলেছেন ‘রত্ন প্রসূতি’। শুধু সেরা দার্শনিকগণই নন, তাঁদের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলে জন্ম নিয়েছেন অনেক কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার ও শিল্পী। এ আলোচনার বিষয় তাঁদেরই একজন সাধক মহাজন দুর্বিন শাহ্।
হাওড়-বাঁওড় আর বনাঞ্চলে পূর্ণ নদী-বিধৌত এ অঞ্চলে আধ্যাত্মিক তথা বাউল সঙ্গীতের এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ এলাকায় জন্ম নিয়েছেন আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ মরমী কবি হাছন রাজা। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়, বাংলা লোকসঙ্গীতের ধারায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এ অঞ্চলে জন্ম নিয়েছেন সঙ্গীত পুরুষ রাধারমণ, যিনি বাংলা বাউল গানকে তুলে এনেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। লোকসঙ্গীতের এই ধারায় আরেক কীর্তিমান পুরুষ কিংবদন্তী বাউল শাহ্ আব্দুল করিম। তাঁর হৃদয়স্পর্শী বাউল গান বর্তমান প্রজন্মকেও নাড়া দিয়ে যায়।
এই আধ্যাত্মিক অঞ্চলে জন্ম নিয়েছেন দুর্বিন শাহ, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, শাহ নূর, গিয়াস উদ্দিনসহ আরও অনেক কবি, যাঁদের রচনা বাংলা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। উপমহাদেশের সঙ্গীত জগত্ আজও তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তাঁরা তাঁদের রচনায় যে দর্শন রেখে গেছেন, তা আমাদের গবেষণার বিষয়।
ভাবজগতের বাসিন্দা সাধক দুর্বিন শাহ্ নিজে গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং তিনি গেয়েছেনও। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দুর্বিন শাহ্ আত্মতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, বিরহ-বিচ্ছেদ, মারফতী, মুর্শিদী, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধকসহ বহু গান লিখেছেন। গান লেখার ক্ষেত্রে তাঁর পাণ্ডিত্যেরও প্রমাণ মেলে।
যেমন তিনি লিখেছেন,
‘আমায় ক্ষমা কর হে প্রভু অপরাধ আমার,
রহমান ও রহিম তুমি জলিল জব্বার’
দুর্বিন শাহ দেহতত্ত্ব নিয়েও অনেক গান লিখেছেন। যেমন : ‘আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন লাইনে ভাই, হবে যদি পেসেঞ্জার, তাড়াতাড়ি টিকেট কাট, শ্রীগুরু টিকেট মাস্টার’ অথবা
‘অচিনা এক জংলা পাখি, থাকে মাটির পিঞ্জিরায়,
ধরা দেয় না ঘরে বাইরে, আসা-যাওয়া সর্বদায়।’
দেশাত্মবোধক অনেক গানও লিখেছেন সাধক দুর্বিন শাহ্। তাঁর গানের মধ্যে ফুটে ওঠে সকল জাতি-ধর্মের কথা। মূলত সাধকদের তো কোনো জাত-পাত নেই। তাঁরা মানব কল্যাণেই নিজের ধ্যান-জ্ঞান করে থাকেন। প্রকৃতি এবং মানুষকে আপন বলয়ের মানচিত্রের অংশীদার হিসেবেই ভেবে থাকেন সাধকরা। তাই যে কোনো ধর্মের চিহ্নিত মানুষই তিনি হোন না কেন, তাঁর পরিচয় একটাই—তিনি ধ্যানমগ্ন মানব কল্যাণে। এর বাইরে আর কিছু ভাবেন না সাধকরা। দুর্বিন শাহ্ তাই খেন,
‘রাধার কথা নাই কি তোমার মনে, রাধার বন্ধুয়া ও,
পাশরিলা বল কোন পরানে’
বা
‘শুন গো সোহাগিনী আর হইও না পাগলিনী
আসবে তোমার শ্যামা নাগর কালিয়া’।
আইও বন্ধু আইও বন্ধু, আইও আমার বাড়ি,
আমার বাড়ি আইও বন্ধু নেপুর হাতে লইয়া,
ঘরে বাদী কাল ননদী, থাকে কান পাতিয়া,
আস যদি আমার বাড়ি, পালংকে শুয়াইয়া,
পান খাওয়াবো গান শুনাবো, দুঃখ ব্যথা লইয়া।
দুর্বিন শাহ্’র গানের একাধিক সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার বলে জানিয়েছেন দুর্বিন শাহ্’র ছেলে শাহ্ মো. আলম শরীফ।
দুর্বিন শাহ্ ১৯৬৮ সালে ইস্টার্ন ফিল্ম ক্লাবের আমন্ত্রণে ব্রিটেনে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে তিনি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি ও আরবি ভাষায় গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে ইস্টার্ন ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘জ্ঞানের সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটেনে উদ্যাপিত হয় দুর্বিন শাহ্ লোকউত্সব ।
১৯৭৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মরমী সাধক দুর্বিন শাহ্ ইহলোক ত্যাগ করেন। ছাতকের ঐতিহাসিক দুর্বিন টিলার সাড়ে চারশ’ ফুট উপরে সাধক বাবা সফাত্ শাহ্র মাজারের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন দুর্বিন শাহ্। তাঁর স্মরণে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ এবং ১৯ তারিখে ওরস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এতে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অনেক অনুরাগী ও ভক্তবৃন্দ অংশ নিয়ে থাকেন।

রাধারমণ দত্ত বা রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ
 (জন্ম ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ, ১২৪০ বাংলা, - মৃত্যু ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৩২২ বাংলা) বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্য-এর প্রবর্তক। সংগীতানুরাগীদের কাছে তিনি রাধারমণ, ভাইবে রাধারমণ বলেই সমাধিক পরিচিত। বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত । তাঁর রচিত ধামাইল গান সিলেট ও ভারতে বাঙ্গালীদের কাছে পরম আদরের ধন। রাধা রমন নিজের মেধা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। কৃষ্ণ বিরহের আকুতি আর না পাওয়ার ব্যথা কিংবা সব পেয়েও না পাওয়ার কষ্ট তাকে সাধকে পরিণত করেছে। তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরণের কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন।
রাধারমণ দত্ত

বংশ পরিচিতি

শ্রীহট্ট বা সিলেট অঞ্চলের পঞ্চখণ্ডে ত্রিপুরাধিপতি ধর্ম ফাঁ কর্তৃক সপ্তম শতকে মিথিলা হতে আনিত প্রসিদ্ধ পাঁচ ব্রাহ্মণের মধ্যে আনন্দ শাস্ত্রী নামক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাধারমণ দত্তের পুর্ব পুরুষ ছিলেন বলে অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ঐতিহাসিক গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে পাওয়া যায়। আনন্দ শাস্ত্রীর প্রৌপুত্র নিধিপতি শাস্ত্রীর পুত্র ভানু নারয়ন নামক ব্যক্তি তত্কালিন মণুকুল প্রদেশে "ইটা" নামক রাজ্যের স্থপতি। উক্ত ভানু নারায়ণের চার পুত্রের মধ্যে রামচন্দ্র নারায়ণ বা ব্রহ্ম নারাণের এক পুত্র ছিলেন প্রভাকর। মুঘল সেনাপতি খোয়াজ উসমান দ্বারা ইটা রাজ্য অধিকৃত হলে, এই রাজ বংশের লোকগণ পালিয়ে গিয়ে আশে পাশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় গ্রহন করেন । এ সময় প্রভাকর দত্ত তার পিতার সাথে আলিসারকুল চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন বসবাস করার পর জগন্নাথপুর রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। কিছু দিন পর জগন্নাথপুর রাজ্যের তত্কালীন অধিপতি রাজা বিজয় সিংহের অনুমতিক্রমে প্রভাকর জগন্নাথপুরের নিকটস্থ কেশবপুর গ্রামে বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন । পরবর্তিতে রাজা বিজয় সিংহ প্রভাকরের পুত্র সম্ভুদাস দত্তকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। অতপর বানিয়াচংয়ের রাজা গোবিন্দ খা বা হবিব খার সাথে বিবাদে জগন্নাথপুর রাজ বংশের বিপর্য্যয়ের কারণ, রাজআশ্রীত কর্মচারিরাও দৈন্য দশায় পতিত হন । এ সময় সম্ভুদাস দত্তের পুত্র রাধামাদব দত্ত অন্যের দ্বারাস্থ না হয়ে, অনন্যচিত্তে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। রাধা মাধব দত্ত সংস্কৃত ভাষায় জয়দেবের বিখ্যাত গ্রন্থ গীত গোবিন্দ' বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন । এছাড়া তার রচিত ভ্রমর গীতিকা, ভারত সাবিত্রী, সূর্যব্রত পাঁচালি, পদ্ম-পুরাণ ও কৃষ্ণলীলা গীতিকাব্য উল্লেখযোগ্য। এই প্রসিদ্ধ কবি রাধামাধব দত্তই ছিলেন রাধারমণ দত্তের পিতা।

সাধনা ও বৈরাগ্য

কবি রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তাঁর পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীতগৌবিন্দ এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা তাকেও প্রভাবিত করেছিল। ১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমণ পিতৃহারা হন এবং মা সুবর্ণা দেবীর কাছে বড় হতে থাকেন। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দ বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতার রচিত গ্রন্থ গুলো সে সময় তাঁর জন্য পিতা আদর্শ হয়ে অন্তরে স্থান করে নিল। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রচনা করেন হাজার হাজার বাউল গান । লিখেছেন কয়েক শ ধামাইল গান। ধামাইল গান সমবেত নারীকন্ঠে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত হয়। বিশেষত সিলেট, কাছাড়, ত্রিপুরা ও ময়মসিংহ অঞ্চলে একসময় এর প্রচলন খুব বেশি ছিল। রাধারমণ দত্ত একাধারে গীতিকার, সুরকার, ও শিল্পী ছিলেন। জানা যায়, সাধক রাধারমণ দত্ত ও মরমি কবি হাসন রাজার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। অন্তরের মিল ছিল খুব বেশী। তাঁদের মধ্য বিভিন্ন সময় পত্রালাপ হতো কবিতায়। একবার হাসন রাজা রাধারমণের কুশল জানতে গানের চরণ বাঁধেন : রাধারমণ তুমি কেমন, হাছন রাজা দেখতে চায়। উত্তরে রাধারমণ লিখেনঃ- কুশল তুমি আছো কেমন - জানতে চায় রাধারমণ। রাধারমণ একজন কৃঞ্চপ্রেমিক ছিলেন। কৃঞ্চবিরহে তিনি লিখেছেন অসংখ গান। এ সব গানের মধ্যে বিখ্যাত দুটি গান হচ্ছেঃ
কারে দেখাবো মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া ।
অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া গইয়া ।।
ঘর বাঁধলাম প্রাণবন্ধের সনে কত কথা ছিল মনে গো ।
ভাঙ্গিল আদরের জোড়া কোন জন বাদী হইয়া ।।
কার ফলন্ত গাছ উখারিলাম কারে পুত্রশোকে গালি দিলাম গো ।
না জানি কোন অভিশাপে এমন গেল হইয়া ।।
কথা ছিল সঙ্গে নিব সঙ্গে আমায় নাহি নিল গো ।
রাধারমণ ভবে রইল জিতে মরা হইয়া ।।
ভ্রমর কইয়ো গিয়া,
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে,
ভ্রমর কইয়ো গিয়া ।।
ভ্রমর রে, কইয়ো কইয়ো কইয়োরে ভ্রমর,
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া মুই রাধা মইরা যাইমু
কৃষ্ণ হারা হইয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।।
ভ্রমর রে, আগে যদি জানতামরে ভ্রমর, যাইবারে ছাড়িয়া
মাথার কেশও দুই’ভাগ করি
রাখিতাম বান্দিয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।।
ভ্রমর রে, ভাইবে রাধারমন বলে শোনরে কালিয়া
নিব্বা ছিলো মনের আগুন
কে দিলা জ্বালাইয়ারে, ভ্রমর কইয়ো গিয়া।।

তিনি বাল্যাবধি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। শাস্ত্রীয় পুস্তকাদীর চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যদি নানা মত ও পথের সঙ্গে পিরিচিত হন। কবির সংসারজীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় নি। শুধু জানা যায়, রাধারমণ-গুণময় দেবীর ৪ ছেলে ছিল। তাঁদের নাম- রাজবিহারী দত্ত, নদীয়াবিহারী দত্ত, রসিকবিহারী দত্ত ও বিপিনবিহারী দত্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় একমাত্র পুত্র বিপিনবিহারী দত্ত ছাড়া বাকি ৩ পুত্র এবং স্ত্রী গুণময় দেবী অকালে মারা যান। স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোক গমনে কবি রাধারমণ দত্ত সংসারজীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। ১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তাঁর কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তাঁর সাধন-ভজন। কবি নিজেই গেয়েছেন ঃ
শ্যামের বাঁশিরে ঘরের বাহির করলে আমারে
যে যন্ত্রণা বনে যাওয়া গৃহে থাকা না লয় মনে ॥
নলুয়ার হাওরের আশ্রম দিবা রাত্র সাধনা ও ইষ্ট নামে মগ্ন এবং অসংখ্য ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ধ্যান মগ্ন অবস্হায় তিনি গান রচনা করে গেয়ে যেতেন। ভক্তরা শুনে শুনে তা স্মৃতিতে ধরে রাখত এবং পরে তা লিখে নিত ।

রাধারমণের গীতি সংগ্রাহক

বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে। সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কলিকাতা থেকে বাউল কবি রাধারমণ নামে ৮৯৮ টি গান নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মোহাম্মদ মনসুর উদ্দীন তার হারামনি গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে রাধারমণের ৫১ টি গান অন্তর্ভুক্ত করেন। সিলেটের মদন মোহন কলেজের সাহিত্য পরিষদ থেকে রাধারমণ সঙ্গীত নামে চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষনের সংগ্রীহিত একটি গ্রন্থ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া গুরুসদয় দত্ত, নির্মলেন্দু ভৌমিক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, কেতকী রঞ্জন গুণ, মুহাম্মদ আব্দুল হাই, হুছন আলী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, নরেশ চন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত র্শমা, মুহম্মদ আসদ্দর আলী, মাহমুদা খাতুন, ডঃ বিজন বিহারী পুরকাস্থ, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, মোঃ আজিজুল হক চুন্নু, জাহানারা খাতুন, নরেন্দ্র কুমার দত্ত চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর চন্দ্র পাল, অধ্যাপক দেওয়ান মোঃ আজরফ ,শামসুর করিম কয়েস সহ আরও অনেক বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ করেছেন। রাধারমণের আর কয়েকটি জনপ্রিয় গানঃ
প্রাণ সখিরে
ঐ শোন কদম্বতলে বাঁশি বাজায় কে।
বাঁশি বাজায় কে রে সখি, বাঁশি বাজায় কে ॥
এগো নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি, তারে আনিয়া দে।
অষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি, মধ্যে মধ্যে ছেদা
নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি, কলঙ্কিনী রাধা ॥
কোন বা ঝাড়ের বাঁশের বাঁশি, ঝাড়ের লাগাল পাই।
জড়ে পেড়ে উগরাইয়া, সায়রে ভাসাই ॥
ভাইবে রাধারমণ বলে, শুন গো ধনি রাই।
জলে গেলে হবে দেখা, ঠাকুর কানাই ॥

শ্যামল বরণ রূপে মন নিল হরিয়া
কুক্ষণে গো গিয়াছিলাম জলের লাগিয়া
কারো নিষেধ না মানিয়া সখি গো ।।
আবার আমি জলে যাব ভরা জল ফেলিয়া
জল লইয়া গৃহে আইলাম প্রাণটি বান্ধা থুইয়া
আইলাম শুধু দেহ লইয়া সখি গো ।।
কি বলব সই রূপের কথা শোন মন দিয়া
বিজলি চটকের মতো সে যে রইয়াছে দাঁড়াইয়া
আমার বাঁকা শ্যাম কালিয়া সখি গো ।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম ঘরের বাহির হইয়া
আমি না আসব ফিরিয়া সখি গো ।।

মান ভাঙ রাই কমলিনি চাও গো নয়ন তুলিয়া
কিঞ্চিত দোষের দোষী আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া।
এক দিবসে রঙে ঢঙে গেছলাম রাধার কুঞ্জে
সেই কথাটি হাসি হাসি কইলাম তোমার কাছে।
আরেক দিবস গিয়া খাইলাম চিড়া পানের বিড়া
আর যদি যাই চন্দ্রার কুঞ্জে দেওগো মাথার কিরা।
হস্তবুলি মাথে গো দিলাম তবু যদি না মান
আর কতদিন গেছি গো রাধে সাক্ষী প্রমাণ আন।
নিক্তি আন ওজন কর দন্দলে বসাইয়া
অল্প বয়সের বন্ধু তুমি মাতি না ডরাইয়া।
ভাইরে রাধামরণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আইজ অবধি কৃষ্ণনাম দিলাম গো ছাড়িয়া।

কৃষ্ণ আমার আঙিনাতে আইতে মানা করি।
মান ছাড় কিশোরী।
যাও যাও রসরাজ, এইখানে নাহি কাজ
যাওগি তোমার চন্দ্রাবলীর বাড়ি।
চন্দ্রাবলীর বাসরেতে সারারাত পোহাইলার রঙ্গে
এখন বুঝি আইছ আমার মন রাখিবারে।
ভাবিয়া রাধারমণ বলে দয়ানি করিবে মোরে
কেওড় খোলো রাধিকা সুন্দরী।

তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া ,সামহোয়্যার ইন ব্লগ

সুনামগঞ্জ জেলা তথ্য বাতায়ন ও ইন্টারনেট

২টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সুনামগঞ্জের অজানা ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে

নামহীন বলেছেন...

Thanks